বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় আন্তর্জতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ বা “ইসকন”। আর এই বিষয়ের নেপথ্যে যার নাম তিনি হলেন “চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী”। ইসকন সমর্থক ও সনাতন ধর্মাবলম্বীর অনেকেই তাকে প্রভু বলেও ডাকেন। যদিও সর্বোচ্চ সম্মানী ব্যক্তি হিসেবে তাকে প্রভু ডাকা হলেও বর্তমানে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ একজন ঘৃনিত ব্যক্তি। কারন রাষ্ট্রদ্রোহের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর মত গুরুতর অভিযোগ এখন তার বিরূদ্ধে। সম্প্রতি তার গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে রাষ্ট্রের এক আইন কর্মকর্তাকে জবাই করে হত্যা করে তার সমর্থকেরা। ফলে বাংলাদেশের মানুষের কাছে চিন্ময় এখন এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম।
চিন্ময়ের পরিচয়:
চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের প্রকৃত নাম “চন্দন কুমার ধর”। স্থানীয়দের কাছে চন্দন সাধু নামে সর্বাধিক পরিচিত। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার সাতকানিয়া সদর ইউপির করইয়ানগর ১নং ওয়ার্ড বণিক পাড়ায় তার গ্রামের বাড়ি। পিতা আশুতোষ ধর (আশু মাষ্টার) ও মাতা সন্ধ্যা রানী ধরের চার সন্তানের চতুর্থ সন্তান চন্দন। বড় ভাই রঞ্জন কুমার ধর মেজ ভাই অঞ্জন কুমার ধর ও বোন রুনা ধরের পরে তার জন্ম। শিক্ষা সনদ অনুসারে ১৯৮৫ সালে তার জন্ম হয়। আকষ্মিক বিষয় হলো, তার জন্মের আগের দিনই তার পিতার মৃত্যু হয়। একদিকে তার মা যখন প্রসব বেধনায় কাতরাচ্ছিলেন তখন অপরদিকে তার পিতাকে শ্মশানের চিতায় তুলেছিল প্রতিবেশীরা। সেমতে অনেকের কাছেই চন্দন একজন অপয়া সন্তান, যে পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগ মুহূর্তেই তার বাবা মৃত্যু বরণ করেছেন।
চন্দনের শৈশব ও পড়াশুনা:
চন্দনের শৈশব কাটে করইয়ানগর গ্রামে। মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা চালিয় যান বাড়ীর পার্শবর্তী করইয়ানগর বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়ের তথ্যমতে ২০০১ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন চন্দন। তবে সেবছর ইংরেজি বিষয়ে ফেল করেন তিনি। কিন্তু পরের বছর ২০০২ সালে পুনঃরায় পরীক্ষা দিয়ে মাধ্যমিক পাশ করেন চন্দন। অতএব, সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসএসসি ফেল বলে গুজব উঠেছে বিদ্যালয়ের তথ্যানুসারে তার সত্যতা মিলে।
এছাড়া শৈশব থেকেই পূজা আর্চনায় লিপ্ত থাকতেন চন্দন। বাড়ির পাশে করইয়ানগর হরি মন্দিরের সামনে বট গাছের নিচে দিনের বেশিরভাগ সময় পূজায় লিপ্ত থাকতেন চন্দন। তবে গ্রামে ছিলেননা বেশীদিন। এসএসসি পরীক্ষার পর ২০০৩ সালে হাটহাজারীতে চলে যান চন্দন। তখন থেকে এলাকায় আসতেন খুব কম।
এলাকায় চন্দনের কর্মকান্ড:
চন্দনের বিরুদ্ধে এলাকায় মন্দিরের নামে জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে। তবে এলাকায় না থাকায় সেসব দখলকৃত জমি বেশিদিন টিকিয়ে রাখতে পারেনি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক প্রতিবেশী বলেন, মন্দিরে মহোৎসবে কীর্তন পাঠের জায়গা করার জন্য আমার জায়গা দখল করেছিলেন চন্দন সাধু। আমি তার সাথে শক্তিতে না পেরে আদালতের ধারস্থ হয়েছি। দীর্ঘ সময় পরে আমি আদালতের রায় আমার পক্ষে পাওয়ার পর স্থানীয় এক রাজনৈতিক ব্যক্তির সহায়তায় জায়গা ফিরে পেয়েছি। এছাড়াও ঐ ব্যক্তির ভাষ্যমতে পার্শ্ববর্তী এমন অনেকের সাথে তার জায়গা জমির সমস্যা ছিল। বিশেষ করে মন্দিরের নামে জমি ক্রয় করার নাম দিয়ে সে নিজ নামে জমি ক্রয় করেছে। পরবর্তীতে মামলা মোকদ্দমার মাধ্যমে সব জায়গা জমি গত বছর মন্দিরের নামে হয়ে যাওয়ার পর সে এলাকা থেকে সম্পূর্ণ বিমূখ হয়ে গেছে। বর্তমানে এলাকার সাথে তার কোন প্রকার সম্পর্ক নেই বললেই চলে।
চন্দনের ইসকন সম্পৃক্ততা:
মাধ্যমিক পরীক্ষার পর চন্দন হাটহাজারী পুন্ডরিক ধামে চলে যান। সেখান থেকেই শুরু হয় তার ইসকন সম্পৃক্ততা। চন্দন থেকে নাম হয় চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারী প্রভু। পরবর্তীতে ইসকনের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন চন্দন। কিন্তু ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে চন্দনের বিরূদ্ধে শিশু নিপীড়নের অভিযোগে তার উপর ইসকনের যুক্তরাজ্য কার্যালয় থেকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় যেটি এখনো বহাল রয়েছে। পরবর্তীতে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে চন্দনকে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে ইসকন থেকে বহিস্কার করা হয়। এমনকি বর্তমানে তার বিরুদ্ধে আনীত কোন অভিযোগের দায় নিচ্ছেনা ইসকন বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দরা।
সম্প্রতি রাজধানীর স্বামীবগে ইসকন কর্তৃক আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক চারু চন্দ্র দাশ বলেন, চিন্ময় কৃষ্ণ দাশের বক্তব্য, কর্মকান্ড একান্তই তার ব্যক্তিগত, এসবের দায় নেবে না সংগঠন। কিন্তু দেশীয় নেতারা তার পক্ষে না দাড়ালেও ইসকনের কেন্দ্রীয় শাখা তার পক্ষে অবস্থানের ঘোষণা দিয়েছেন। গত ২৯ নভেম্বর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে এক পোস্টের মাধ্যমে ইসকনের প্রধান শাখা এ বিষয়টি নিশ্চিত করেন। ফলে দেশীয় ইসকন নেতাদের দায় এড়ানোটা একান্তই রাজনৈতিক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, বর্তমানে দেশব্যাপী ইসকন নিষিদ্ধের যে ডাক উঠেছে সেখান থেকে বাঁচতেই মূলত ইসকন বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দের এই অবস্থান।
সাম্প্রতিক কার্যক্রম:
এতদিন চন্দনের কার্যক্রম জনসম্মূখে না আসলেও সাম্প্রতিক কার্যক্রম শুরু হয় ৫ আগস্ট পরিবর্তিত পরিস্থিতির পর থেকে। ইতিপূর্বে ইসকনের হয়ে কর্যক্রম চালালেও সাম্প্রতিক কর্যক্রম চালায় বাংলাদেশ সনাতনী জাগরণ জোটের মূখপাত্র হিসেবে। এ সময় তার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরীর লক্ষ্যে বিভিন্ন উস্কানিমূলক বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগ করা হয়। এছাড়াও সম্প্রতি চট্টগ্রামে হাজারী লেনে যৌথ বাহীনির উপর এসিড নিক্ষেপের ঘটনায় তার ইন্ধনের অভিযোগ করা হয়। সবশেষ চট্টগ্রামের নিউ মার্কেট এলাকায় জাতীয় পতাকার উপর গেরুয়া পতাকা উড়িয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অবমাননার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। সেই মামলায় গত ২৫ নভেম্বর তাকে ঢাকা বিমান বন্দর থেকে গ্রেফতার করা হয়। পরদিন তাকে চট্টগ্রাম আদালতে তুলা হলে আদালত তাকে জামিন নামঞ্জুর করেন। এসময় তার সমর্থকেরা একজন তরুণ আইনজীবীকে জবাই করে হত্যা করে। এ নিয়ে ইতোমধ্যে সারাদেশে ইসকন নিষিদ্ধের দাবি উঠেছে।
যার কারণে দেশে সমস্যা, সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ তার গ্রাম:
চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার সাতকানিয়া সদর ইউপির করইয়ানগর গ্রামে চন্দনের বাড়ী। এই গ্রামে বিশেষ করে হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিমদের বসবাস। এই গ্রামে ছোট ছোট দুটি বিশেষ জায়গা রয়েছে, যার একটির নাম দলিয়ার দোকান ও অপরটি জোড় পুকুর পাড়। এই দুই স্থানে গেলে সাধারণ একজন মানুষ কখনো বুঝতে পারবেনা একই সাথে বসে তিন সম্প্রদায়ের মানুষ আড্ডা দিচ্ছেন। চা, সিগারেট, পান খাচ্ছেন একে অপরের কাছ থেকে কাড়াকাড়ি করে। কাজে যাচ্ছেন একসাথে এবং দিন শেষে কাজ থেকে ফিরছেনও একসাথে। মুসলিমরা ডাক দিলেই শুনা যাচ্ছে হিন্দু-বৌদ্ধের বাড়িতে আর হিন্দু-বৌদ্ধরা ডাক দিলেই শুনা যাচ্ছে মুসলিমদের বাড়িতে। যেকোনো বিশেষ আয়োজনে একে অপরকে আমন্ত্রণ জানানোটা এ গ্রামের একটি নিয়মিত প্রথায় রূপান্তরিত হয়েছে। চন্দনের বাড়ির কয়েক গজের মধ্যে হরি মন্দিরের অবস্থান, পরের একশো গজের মধ্যে বৌদ্ধ মন্দির ও আরেকশো গজের মধ্যে মসজিদ। নির্দিষ্ট সময়ে প্রত্যেকেই তার ধর্ম পালন করছেন। মুসলিমরা মসজিদে আযান দিচ্ছেন আর হিন্দু-বৌদ্ধরা মন্দিরে ঘন্টি বাজাচ্ছেন। প্রার্থনা শেষে আবারো চায়ের দোকানে সবাই জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। এক কথায় সম্প্রীতির অনন্য এক উদাহরণ করইয়ানগর গ্রাম। কিন্তু এমন এক সম্প্রীতির গ্রাম থেকে বেড়ে উঠা চন্দনের বিরুদ্ধে আজ সারাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর অভিযোগ।
চন্দনের কর্মকান্ডে বিব্রত স্থানীয়রা:
বর্তমানে চন্দন এখন জাতীয় ইস্যু। রাষ্ট্রদ্রোহীতা ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর মত গুরুতর অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। বিশেষ করে একের পর এক উস্কানিমূলক বক্তব্য, সভা সমাবেশ, কেবল চন্দনের জন্য নয়, বরং দেশব্যাপী সনাতনী সম্প্রদায়ের জন্য হুমকি স্বরূপ। কারণ বাঙালির ইতিহাসে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মত জঘন্য ঘটনাও লিপিবদ্ধ আছে। যদিও সম্প্রতি ঘটে যাওয়া তার সমর্থক কর্তৃক আইনজীবী হত্যার ঘটনায় বাঙালি জনগোষ্ঠী যেমন ধৈর্য্যের পরিচয় দিয়েছে তেমনি এই ঘটনা সম্প্রীতির উদাহরণ হয়ে থাকবে ইতিহাসে। তবে তার এমন কর্মকান্ডে বিব্রত স্থানীয়রা।
স্থানীয় বাসু ধর বলেন, আমরা মনে করি এই গ্রামে আমরা মুসলিমদের ছায়াতলে থাকি। কারণ আমার মনে আছে এখনো, আমার দাদা বলতেন, এই গ্রামে একজন নদভী সাহেব নামে ব্যক্তি ছিলেন। যুদ্ধের সময় যখন পাকিস্তানিরা মহাসড়কের ঠাকুরদীঘি হয়ে এই গ্রামে ঢোকার চেষ্টা করতেন তখন তিনি মহাসড়কে গিয়ে দাড়িয়ে থাকতেন। তিনি পঞ্জাবীদেরকে বলতেন, এই গ্রামে যারা আছে তারা সবাই আমার মানুষ। তাদেরকে মারতে হলে আমি নিজ হাতে মারব। আপনাদের গ্রামে প্রবেশ করতে হবে না।
এছাড়াও প্রয়াত হোসেন মেম্বারের কথা শুনেছি। তিনি যুদ্ধের সময় বয়স্ক হিন্দু-বড়ুয়াদের নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন। তার তরমুজ ক্ষেতের শত শত তরমুজ তাদেরকে খাইয়েছেন। যাকে যেভাবে পেরেছেন নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছেন। এই গ্রামে আমরা হিন্দু-বৌদ্ধরা মনে করি, আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম মুসলিমদের ছায়াতলে ছিলেন এবং বর্তমানে আমরাও আছি। কিন্ত সম্প্রতি যেসব ঘটনা ঘটছে, এসব আমাদেরকে বিব্রত করছে। আমারা নিশ্চিত যে, এই গ্রামে কোন অপ্রীতিকর কিছু ঘটবে না। কিন্তু দেশের অন্যকোন স্থানেতো ঘটতে পারে! আমরা দেশবাসীকে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |