
সারাদেশ: চট্টগ্রামের বাকলিয়া এক্সেস রোডে একটি প্রাইভেটকারের গতিরোধ করে ব্রাশফায়ারে চারজন গুলিবিদ্ধ হয়। এ ঘটনায় দু’জন নিহত হয়েছে। গুরুতর আহত অবস্থায় আরও দু’জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। শনিবার (২৯ মার্চ) দিবাগত রাত পৌনে ৩টার দিকে বাকলিয়া এক্সেস রোডের মুখে এ ঘটনা ঘটে। নিহত ব্যক্তিরা হলেন মোহাম্মদ মানিক (৩০) ও আবদুল্লাহ (৩২)। মানিক পেশায় গাড়িচালক। তার বাড়ি হাটহাজারী মদুনাঘাটে। চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদ ওরফে ‘বুড়ির নাতি’র সঙ্গে আরেক ক্যাডার সারোয়ার হোসেন বাবলার পুরোনো দ্বন্দ্ব ছিল। সম্প্রতি ছোট সাজ্জাদকে ‘ধরিয়ে দেয়া’ এবং তাদের মধ্যকার রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের নেশা সেই আগুনে ঘি ঢালে। এসব নিয়ে ছোট সাজ্জাদের লোকজন সারোয়ারকে খুন করতে হামলা চালাতে পারে-এমন ধারণা শনিবার গভীর রাতে নগরের চকবাজার থানার চন্দনপুরা এলাকায় গুলিবিদ্ধ আহত ও নিহতের স্বজনদের।
এদিকে তদন্তের আগে এ বিষয়ে নির্দিষ্ট তথ্য জানাতে পারছে না পুলিশ। ঘটনাস্থলে কী ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল-জানা যাবে ফরেনসিক প্রতিবেদন পেলে। তবে বালু মহালের দ্বন্দ্ব এবং ছোট সাজ্জাদকে ধরিয়ে দেয়ার রেশ-খুনের পেছনে; এই দুই কারণকে সামনে রেখে তদন্তে এগোচ্ছে পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাত পৌনে ৩টার দিকে বাকলিয়া এক্সেস রোডের গুলজার বেগম মোড়ে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। ভারী অস্ত্র নিয়ে বেশ কয়েকজন যুবক একটি প্রাইভেটকারকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে থাকে। অল্প সময়ের মধ্যে তারা সেখান থেকে পালিয়ে যায়। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শনিবার মধ্যরাত থেকেই কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতু এলাকায় বালু মহালের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে অবস্থান করছিলো সন্ত্রাসীদের দুটি গ্রুপ। এর মধ্যে চট্টগ্রামের অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী সারোয়ার বাবলার নেতৃত্বে একটি প্রাইভেটকারে ছিলেন নিহত মানিক, আবদুল্লাহ, ইমন এবং রবিনসহ ৬ জন।
কী ঘটেছিল সেখানে
রোববার দুপুরে প্রাণে বেঁচে ফেরা রবিনের সঙ্গে এক গণমাধ্যমকর্মীর কথা হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তিনি জানান, রাত ৯টার দিকে নিহত আবদুল্লাহ তাকে ফোন করে ঈদের শপিংয়ে যাওয়ার কথা বলেন। নিউমার্কেট যেতে প্রাইভেটকারটি ভাড়া করেন আবদুল্লাহ। এরপর তাকে অক্সিজেন এলাকার বাসা থেকে তুলে নেন। গাড়িতে তখন মো. মানিক (নিহত অপরজন) ও মো. ইমন ছিলেন।
রবিন জানান, নিউমার্কেট যাওয়ার পথেই সারোয়ার বাবলা ফোন করে আবদুল্লাহকে নতুন ব্রিজ এলাকায় যেতে বলেন। সারোয়ারের সঙ্গে আবদুল্লাহর আগে থেকে পরিচয় ছিল এবং তার সঙ্গে রাজনীতি করতেন। সেখানে তারা রাত ১২টার দিকে পৌঁছান। ওই সময় সারোয়ারের সঙ্গে আরও ১০-১২ জন ছিল। রাত দুটা থেকে আড়াইটার দিকে সারোয়ার গাড়ি বের করতে বলেন। এরপর সারোয়ার, আবদুল্লাহ, ইমন, রবিন এবং মানিকসহ ৬ জন বহদ্দারহাটের দিকে রওয়ানা হন। তিনি বলেন, ‘রওয়ানা হওয়ার মিনিট দুয়েকের মধ্যেই পেছন থেকে কয়েকটি মোটরসাইকেলে করে তাদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে কয়েকজন। প্রত্যকটি মোটরসাইকেলে ছিল দুজন করে। ধাওয়া করার একপর্যায়ে তারা কালামিয়ার বাজার দিয়ে বাকলিয়া এক্সেস রোড-চন্দনপুরা সড়কের মুখে একটি পুলিশের টহল গাড়ি দেখে তাদের গাড়ি (প্রাইভেটকার) থামান এবং পুলিশের কাছে বাঁচানোর আকুতি জানান। এ সময় তারা ছয়জনই এলোপাতাড়ি দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছু বোঝার আগেই পেছনে মোটরসাইকেলে আসা সন্ত্রাসীদের মুহুর্মুহু গুলিতে আবদুল্লাহ ও মানিক ঘটনাস্থলে মারা যান। তিনি ও হৃদয় পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন।’
সারোয়ারকে খুন করাই ছিল টার্গেট
রবিনের ধারণা, সম্প্রতি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া সন্ত্রাসী সাজ্জাদ হোসেনের লোকজন এর সঙ্গে জড়িত। তিনি বলেন, ‘সাজ্জাদের সঙ্গে সারোয়ারের সম্ভবত আগে থেকে দ্বন্দ্ব ছিল। সম্প্রতি সাজ্জাদের গ্রেপ্তার এবং রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুজনের মধ্যে ঝামেলা বেড়েছে। তাই সাজ্জাদের লোকজন সারোয়ারকে খুন করতে এ হামলা চালাতে পারে।’ মাস দুয়েক আগেও নিহত আবদুল্লাহকে গুলি করেছিল ‘ছোট সাজ্জাদ বাহিনী’। তখন তিনি অবশ্য প্রাণে বেঁচে ফিরেছিলেন।
নিহত আবদুল্লাহর মা রাশেদা বেগম বলেন, ‘মাস দুয়েক আগে সাজ্জাইদ্যা (সাজ্জাদ) রাউজানে আমার ছেলের পায়ে গুলি করেছিল। আমার ছেলে দুই মাস ঘর থেকে বের হতে পারেনি। ঈদের শপিং করার জন্য দুই মাস পর বের হয়েছে। সাজ্জাইদ্যার (সাজ্জাদের) সন্ত্রাসীরা আমার ছেলেকে খুন করেছে। আমি বিচার চাই।’ আবদুল্লাহর স্ত্রী পিয়ামণি সংবাদমাধ্যমকে জানান, সাজ্জাদ গ্রুপের লোকজন আমার স্বামীকে খুন করেছে। আবদুল্লাহ কেন সারোয়ারের সঙ্গে থাকে, তার সঙ্গে কথা বলে-এজন্য সাজ্জাদের খুব রাগ। আবদুল্লাহকে পায়ে গুলিও করেছিল এর আগে। আমাদের ধারণা, সারোয়ারকে মারতে হামলা করেছিল সাজ্জাদের লোকজন। আবদুল্লাহও তাদের টার্গেট ছিল।’এদিকে, নিহতের পরিবার এ ঘটনায় বাকলিয়া থানায় মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন নগর পুলিশের দক্ষিণ জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মো. মাহমুদুল হাসান মামুন।
তিনি বলেন, ‘প্রাইভেটকারে থাকা দুজনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় তাদের স্বজনরা মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আর আহত দুজন পুরোপুরি শঙ্কামুক্ত রয়েছেন।’ হত্যার মূল কারণ কী-জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হত্যার কারণ আমরা এখনো আইডেন্টিফাই করতে পারিনি যেহেতু এটি তদন্তের বিষয়, তদন্তের পর বিস্তারিত জানা যাবে। এ ঘটনায় এখনো কাউকে গ্রেপ্তারও করা হয়নি।’ কী ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল-এমন প্রশ্নের জবাবে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘এটা ওই ধরনের বড় আর্মস না। এটা সম্ভবত পিস্তল ছিল। আর গাড়ির পেছনে যে দাগগুলো রয়েছে সেগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, গর্ত কিন্তু হয়নি। গর্ত হয়েছে কয়েকটা। যেগুলো গর্ত হয়নি সেগুলো সম্ভবত শর্টগানের লেড থেকে ছড়িয়ে পড়া বুলেট। আর আহতরাও ভারী অস্ত্র ব্যবহারের কথা জানাননি।’