প্রচ্ছদ জাতীয় ঘর ছেড়ে রাস্তা-মাঠে নির্ঘুম রাত, শহর ছাড়ার ভাবনা

ঘর ছেড়ে রাস্তা-মাঠে নির্ঘুম রাত, শহর ছাড়ার ভাবনা

আমার শিশুসন্তানকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতেই পারছিলাম না। হাত-পা যেন কোনো কাজ করছিল না, মাথা ঝিমঝিম করছিল, সঙ্গে বমি পাচ্ছিল। আমি আমার সন্তানকে নিয়ে খুবই ভয় পেয়েছিলাম। পুরো বিল্ডিং নড়ছিল। শেষ পর্যন্ত রাতে খোলা আকাশের নিচে নিরাপদ আশ্রয়ে দীর্ঘক্ষণ ছিলাম। পরে গভীর রাতে ঘরে ফিরি। এখন প্রতি মুহূর্ত কাটাচ্ছি আতঙ্কের মধ্য দিয়ে।’

তৌফিক খান নামে এক শিক্ষার্থী কালবেলাকে বলেন, ‘নিজের জান (জীবন) বাঁচানো ফরজ। তাই গ্রামে চলে যাচ্ছি, কিছুদিন গ্রামে কাটিয়ে আসি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পরে শহরে ফিরব। দুই রাত চোখে কোনো ঘুম নেই। গ্রামে গিয়ে নিশ্চিন্তে একটু ঘুমাব, পরে অন্য সব কথা। তা ছাড়া ভূমিকম্প আতঙ্ক থেকে নিজেকে স্বাভাবিক করতে হলেও বহুতল ভবন থেকে দূরে যেতে হবে।’

শহরের বাসিন্দা ইয়াছিন আরাফাত সুমন বলেন, ‘ভূমিকম্পের ভয়ে দিনে খেতে পারছি না, রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতেও পারছি না। যেখানেই থাকি না কেন সবসময় আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হচ্ছে। চারদিকে শুধু বড় বড় দালানকোঠা, হঠাৎ ভূমিকম্প শুরু হলে বিল্ডিং না ভেঙে যায়, এ ভয়ে রাস্তায়ও বের হতে পারছি না। বিশেষ করে আমরা যারা শহরে থাকি, সবসময় তাদের আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে।’

কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় আমূল ছন্দপতনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে মুদি দোকানি সোহাগ মিয়া বলেন, ‘শুক্রবার সকাল পর্যন্ত সবকিছু স্বাভাবিক থাকলেও মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে দিনটি আতঙ্কের দিন হিসেবে আমাদের জীবনস্মৃতিতে জায়গা করে নিয়েছে। তারপর শনিবার আবার সকালে ও রাতে ভূমিকম্প। পর পর তিনবার ভূমিকম্পে প্রাণ রক্ষার চেষ্টায় সবাই পেরেশান হয়ে উঠি। সর্বত্রই ভেসে আসছিল মানুষের আকুতি। ঘর ছেড়ে মানুষ আতঙ্কে রাস্তায় অবস্থান নেন। আতঙ্কে কান্নায় ভেঙে পড়েন কেউ কেউ।’

নরসিংদী পৌরশহরের একটি সাততলা ভবনে পরিবার নিয়ে থাকেন কামাল মাহমুদ। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘পর পর তিনবার ভূমিকম্প হয়েছে। এখন ঘরে যাওয়ার সাহস নেই। রাতে ঘুমাব কীভাবে, তা নিয়ে ভয়ে আছি। যদি আরও বড় ভূমিকম্প হয়, তবে তা কীভাবে মোকাবিলা করব, সাততলা থেকে কীভাবে নামব— এসব ভাবছি। তাই চিন্তা করছি, কোনোরকমে রাতটা কাটিয়ে কিছুদিনের জন্য পরিবার নিয়ে গ্রামে চলে যাব।’

ভূমিকম্পে প্রাণহানি কমাতে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসরণ করে ভবন নির্মাণ এবং পরিত্যক্ত ঘোষিত সরকারি স্থাপনাগুলো দ্রুত ভেঙে ফেলার তাগিদ দেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) নরসিংদী জেলা সম্পাদক হলধর দাস।

তিনি বলেন, ‘ভবন নির্মাণে নিয়মনীতির তেমন কোনো তোয়াক্কা হয় না। তাই এটা সহজ যে, বড় ভূমিকম্পে ভয়ানক বিপর্যয় নামবে। ভূমিকম্পের মাত্রা একটু বেড়ে ফের আঘাত হানলে নরসিংদীতে অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ বিল্ডিংয়ের কারণে যে প্রাণহানি ঘটবে— তার জন্য পৌরসভা, সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী এবং প্রশাসকরা দায়ী থাকবেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘নরসিংদীতে সরকারি কলেজসহ অনেক পরিত্যক্ত ঘোষিত বিল্ডিং আছে, যা ব্যবহার হচ্ছে। এগুলো দ্রুত ভেঙে ফেলা উচিত। এ ছাড়া, অনুমোদন বহির্ভূত স্থাপনাগুলোর ব্যাপারেও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।’

সাবেক শিক্ষা কর্মকর্তা একেএম শাহজাহান বলেন, ‘আমরা বেশিরভাগ মানুষই এর আগে একবার ভূমিকম্প দেখেছি। এবার যেটা হলো, একাধিকবার। পর পর তিনবার ভূমিকম্প হওয়াটা আতঙ্কের ব্যাপার অবশ্যই। তবে যেহেতু ভূমিকম্পের মূল উৎপত্তিস্থল (শুক্রবারের) নরসিংদীতে, সেক্ষেত্রে নরসিংদীবাসী বাড়তি আতঙ্কে রয়েছে। আবার যে কখন ভূমিকম্প হয়, সে চিন্তায় মানুষের চোখের ঘুম হারাম হয়ে গেছে।’

ভূমিকম্পে জেলায় শতাধিক ঘরবাড়ির আংশিক ক্ষতি হয়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসাইন। তিনি বলেন, ‘শতাধিক লোক আহত হয়েছে। তবে গুরুতর আহতের সংখ্যা কম। চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়ের পর প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে বিস্তারিত জানানো হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘রাতে আতঙ্কিত মানুষ রাস্তায় নেমে আসে গুজব ছড়িয়ে যাওয়ার কারণে। কেউ যাতে গুজবে কান না দেন সবার প্রতি সে অনুরোধ জানাই। পাশাপাশি ভূমিকম্পের ব্যাপারে যেহেতু আগাম কোনো সতর্কবার্তা দেওয়া যাচ্ছে না, সে জন্য সচেতন থাকারও আহ্বান জানাচ্ছি।’

নরসিংদীতে শনিবার সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিটে কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী ভূমিকম্পন অনুভূত হয়েছে। এর আগে সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে এবং শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে ভূমিকম্পে কেঁপে উঠে জনবহুল এই জনপদ। শুক্রবারের ভূমিকম্পে জেলার তিনটি উপজেলায় পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। বেশ কিছু সরকারি-বেসরকারি ও আবাসিক ভবনসহ শতাধিক ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পলাশ উপজেলা।

পলাশের খাদ্য গুদাম, থানা ভবন, উপজেলা পরিষদ ভবন, ফায়ার সার্ভিস ভবন, সমবায় উচ্চ বিদ্যালয়, ঘোড়াশাল মুসাবিন হাকিম ডিগ্রি কলেজ, চরসিন্দুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নতুন ও পুরাতন ভবন, রাবান উচ্চ বিদ্যালয়, ঘোড়াশাল পুরাতন রেলসেতুর একটি পিলারসহ অর্ধশতাধিক ভবনের আংশিক ক্ষতি হয়েছে।

এ ছাড়া নরসিংদী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, জেলা জজ কোর্ট, জেলা নির্বাচন অফিস, জেলা ত্রাণ গুদাম, নরসিংদী সরকারি কলেজ, নরসিংদী সরকারি মহিলা কলেজের হোস্টেল, গাবতলী জামিয়া কাসেমিয়া কামিল মাদ্রাসা, নরসিংদী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, হাজি মোসলে উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়সহ জেলায় শতাধিক ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে।