
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালের সামনে ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে হত্যার ঘটনাকে মব নাটক সাজাতে সেখানে ব্যবসায়ীদের নিয়ে স্লোগান দিচ্ছিলেন ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী যুবদল নেতা মাহমুদুল হাসান মহিন। সোহাগের নিথর দেহের পাশেই দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠেছিলেন মহিন—‘চাঁদাবাজের ঠাঁই নাই!’ ‘আওয়ামী দোসরদের বিচার চাই!’ এ সময় আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে গড়েন এক নাটকীয় মিছিল, যেন সেটিকে মনে হয় জনরোষের বিস্ফোরণ।
তবে নাটকের পর্দা খুব বেশিক্ষণ টেকেনি। হাসপাতালের আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে মহিনের অবস্থান, গতিবিধি ও ভূমিকা স্পষ্ট হয়। এক চৌকস পুলিশ কর্মকর্তা খুনের মাত্র মিনিট দশেক পর মিছিলের মধ্যেই মহিনকে শনাক্ত করেন। গ্রেপ্তারের সময় স্থানীয়ভাবে কিছু বাধা সৃষ্টি হয়, মহিনকে রক্ষা করতে মাঠে নামে তার অনুসারীরা। কিন্তু পুলিশ শক্ত অবস্থানে গেলে শেষরক্ষা হয়নি। পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ঘটনাটি নিছক প্রতিশোধ নয়, এটি ছিল ঠান্ডা মাথার হত্যা কৌশল। হত্যার পর আতঙ্কিত না হয়ে উল্টো নিজেই প্রতিবাদী সেজে জনমত প্রভাবিত করতে চেয়েছিল মহিন।
পুলিশ এবং স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা যায়, প্রকাশ্যে রাস্তায় হত্যা করলে এলাকায় নিজেদের আধিপত্য বিস্তারেও সহজ হবে বলে মনে করেছিলেন চকবাজার থানা যুবদলের সদস্য সচিব পদপ্রার্থী মাহমুদুল হাসান মহিন এবং একই থানার ছাত্রদলের সদস্য অপু দাস। তবে খুনের বিভীষিকাময় ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ভেস্তে যায় খুনিদের গল্প সাজানোর পরিকল্পনা।
কোতোয়ালি থানার ওসি মো. মনিরুজ্জামান বলেন, হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত আসামি সবাইকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ঘটনার আরও তদন্তের পর বিস্তারিত জানা যাবে।
আসামি রাজীব-সজীব রিমান্ডে: সোহাগ হত্যা মামলায় রাজীব বেপারি ও সজীব বেপারি নামে দুই আসামির পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। আসামিরা সম্পর্কে সহোদর।
সোমবার বিকেলে শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাসুম মিয়া রিমান্ডের এ আদেশ দেন। এ সময় তাদের আদালতে হাজির করা হয়। এরপর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান তাদের সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। বিচারক আসামিদের কাছে জানতে চান তাদের পক্ষে কোনো আইনজীবী আছে কি না। তখন আসামি রাজীব বলেন, আমাদের পক্ষে কোনো আইনজীবী নেই। এই যে আমার বড় ভাই (সজীব) এখানে আছে। আমি কিছুই করিনি। আমি নির্দোষ। তবে এ সময় আসামি সজীব কিছু বলেননি। শুনানি শেষে আদালত তাদের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এ ছাড়া অস্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার থাকা আরেক আসামি তারেক রহমান রবিনকে সোহাগ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। গতকাল ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এম মিজবাহ উর রহমানের আদালত তাকে গ্রেপ্তার দেখানোর আদেশ দেন।
এর আগে গত রোববার ভোরে নেত্রকোনার দুর্গাপুর পৌরসভার চায়না মোড় এলাকা থেকে স্থানীয় পুলিশের সহায়তায় রাজীব ও সজীবকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এর আগে সোহাগ হত্যা মামলায় গত ১০ জুলাই মাহমুদুল হাসান মহিনকে পাঁচ দিনের রিমান্ড এবং গত ১২ জুলাই টিটন গাজীর পাঁচ দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন আদালত। এ ঘটনায় করা অস্ত্র আইনের মামলায় গত ১০ জুলাই তারেক রহমান রবিনের দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। রিমান্ড শেষে ১২ জুলাই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এ ছাড়া গত ১৩ জুলাই এ মামলায় আসামি মো. আলমগীর ও মনির ওরফে লম্বা মনিরের চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
এদিকে রাজিব ও সজীবকে নির্দোষ দাবি করে তাদের স্বজনরা বলেন, আসামিদের সঙ্গে নামের মিল থাকায় তাদের গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
পুলিশের গাফিলতির কারণে এমনটা হয়েছে বলে জানান তারা। এর ফলে প্রকৃত খুনিরা বেঁচে গিয়ে নিরীহ মানুষ হয়রানি হচ্ছেন বলে দাবি করেন আটক দুই অ্যাম্বুলেন্স চালক রাজিব ও সজিবের স্বজনরা।
বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জ পৌরসভার চুনারচর ওয়ার্ডের মৃত ইউনুস বেপারির দুই ছেলে রাজিব ও সজীব। একই নামে রাজিব ১০ নম্বর ও সজীব ৭ নম্বর এজাহারভুক্ত আসামি।
মিটফোর্ড এলাকার পরিবহন শ্রমিক মেহেদী হাসান দাবি করেন, গ্রেপ্তার রাজিব ও সজীব তার উপজেলার বাসিন্দা। তারা যে মালিকের গাড়ি চালায় সেই গাড়ির মালিকের নাম সজীব এবং তার ছোট ভাইয়ের নাম রাজিব। তারা ঢাকায় রাজনীতি করেন। মালিকের নামের সঙ্গে মিল থাকায় ড্রাইভাররা জেলহাজতে গিয়েছে। পুলিশের মামলার মূল আসামি অ্যাম্বুলেন্স মালিক রাজিব ও সজীব।
গ্রেপ্তার রাজীব-সজীবের দাদা জালাল বেপারি দাবি করেন, নাতিরা আসামি হয়েছে সেটি তারা টিভি সংবাদের মাধ্যমে জানতে পেরেছেন। তার ভাষ্য, আমার নাতিরা এই মানুষ খুন করতে পারে না। ওরা নির্দোষ। ওদের মালিকের নামে নাম থাকায় গ্রেপ্তার হয়েছে।
আসামিদের পক্ষে লড়বেন না বিএনপির আইনজীবীরা: হত্যাকাণ্ডে আসামিদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করবে না বলে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা বার ইউনিটের বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম। সোমবার ঢাকা আইনজীবী সমিতির দ্বিতীয় তলায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান ফোরামের আহ্বায়ক মো. খোরশেদ আলম।
সংবাদ সম্মেলনে ফোরামের সদস্য সচিব নিহার হোসেন ফারুকের সঞ্চালনায় ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি খোরশেদ মিয়া আলম, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর ইকবাল হোসেন, আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় নেতা আব্দুল খালেক মিলন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।