হিংসার আগুনে পুড়ছে মণিপুর। উত্তর-পূর্বের এই রাজ্যে লাগাতার লুটপাট, অশান্তির খবর মিলছে। মৃত্যুর খবরও সামনে আসছে। মণিপুরে হিংসা শুরু হয় গত বছরের ৩ মে। কিন্তু ১৬ মাস পেরিয়ে গেলেও সেখানে শান্তি ফিরে আসেনি। শনিবার নতুন করে হিংসায় ৫ জন মারা গেছে।
মণিপুরের পরিস্থিতি দেখে বোঝা যায়, সেখানে মেইতেই এবং কুকি দুই সম্প্রদায়ের কাছে এখনও অস্ত্র রয়েছে। শোনা যাচ্ছে, ওই দুই সম্প্রদায়ই পাহাড় ও উপত্যকায় বাঙ্কার তৈরি করেছে। কেন্দ্র সরকার হস্তক্ষেপও করেছে একাধিকবার। সেই রাজ্যের সরকারও তৎপর। কিন্তু তারপরও ১৬ মাস পেরিয়ে গেল। কেন থামছে না হিংসা?
গত বছরের মে মাস থেকে মণিপুরের অবস্থা ভয়াবহ থাকলে ও গত কয়েক মাস ধরে পরিস্থিতি শান্ত ছিল। কিন্তু এখন বিমান বোমা, আরপিজি ও আধুনিক অস্ত্রের জন্য ড্রোন ব্যবহারের পর পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সর্বশেষ হামলার পর পুলিশ সার্চ অপারেশন করে। তখন ৭ দশমিক ৬২ মিমি স্নাইপার রাইফেল, পিস্তল, ইম্প্রোভাইজড লংরেঞ্জ মর্টার (পম্পি ), ইম্প্রোভাইজড শর্ট রেঞ্জ মর্টার, গ্রেনেড, হ্যান্ড গ্রেনেডসহ অনেক আধুনিক অস্ত্র খুঁজে পায়।
বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, এই আবহে রাজ্যপালের সঙ্গে বৈঠক করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন মণিপুরের পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য প্রশাসন সচেষ্ট। সাম্প্রতিক সহিংস সংঘর্ষে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের পাশে রয়েছে তার রাজ্যের বিজেপি সরকার। নিহত এক ব্যক্তির পরিবারের হাতে ক্ষতিপূরণের টাকাও তুলে দেন তিনি।
মণিপুর পুলিশের কর্মকর্তা কে খাবিব (আইজিপি, ইন্টেলিজেন্স) বলেন, রাজ্যে সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনাগুলির কারণে, মণিপুর পুলিশ যৌথ বাহিনীর সঙ্গে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জেলা সদরে রয়েছেন এবং পরিস্থিতি মনিটর করছেন।
দিল্লির মেইতেই আহ্বায়ক কমিটির সেরাম রোজেশ বিবিসিকে বলেন, মণিপুরের বর্তমান পরিস্থিতি কিন্তু খুবই উদ্বেগজনক। আমরা অনুরোধ জানাচ্ছি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে হস্তক্ষেপ করার জন্য। মেইতেই গোষ্ঠীর মানুষের ওপর নির্মম অত্যাচার চলছে।
কুকি সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষা কর্মরত সংগঠনের পক্ষ থেকে হাতজালহই হাওকিপ বলেন, গত একবছরেরও বেশি সময় ধরে মণিপুরে কুকি গোষ্ঠীর মানুষের ওপর যে অত্যাচার চলছে সে বিষয়ে রাষ্ট্র নীরব রয়েছে। আমরা দিল্লিতে কেন্দ্র সরকারকে আমাদের পরিস্থিতির কথা জানিয়েছি। কিন্তু কিছুই হয়নি। এই মুহূর্তে মণিপুরে যা হচ্ছে তা খুবই চিন্তার। কুকিদের ওপর অত্যাচার চলছে এখনো। কিন্তু কেউ কিছু বলছে না।
সংবাদ সংস্থা পিটিআইয়ের তথ্য অনুযায়ী, সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা পাহাড় থেকে কৌত্রুক ও পার্শ্ববর্তী কাদাংবন্দের নিচু এলাকা লক্ষ্য করে হামলা চালায়। হতাহতের পাশাপাশি বহু বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাশেই রয়েছে কুকি জনবহুল পার্বত্য জেলা কাংপোকপি। অভিযোগ সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা কুকি সম্প্রদায়ভুক্ত। এরপর থেকেই বারে বারে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মণিপুরের পরিস্থিতি।
গত সপ্তাহে মইরাংয়ে ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা করা হয় বলে অভিযোগ। এই ঘটনায় এক বেসামরিক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। এর পাশাপাশি মণিপুরের জিরিবাম জেলায় সহিংসতায় চারজন সন্দেহভাজন সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্য ও এক বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। আসাম সীমান্তবর্তী জিরিবামের মংবুং গ্রামের কাছে এ হামলা চালানো হয় বলে অভিযোগ।
পুলিশ জানিয়েছে জিরিবামে মেইতেই সম্প্রদাইয়ের এক প্রবীণ ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ। এই ঘটনার পর সহিংসতা আরও ছড়িয়ে পড়ে। ওই এলাকায় এখনো উত্তেজনা রয়েছে এবং পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে অতিরিক্ত নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। পুলিশের দাবি, রাজ্যে সাম্প্রতিক হিংসায় অত্যাধুনিক ড্রোন ও আরপিজি (রকেট চালিত বন্দুক) ব্যবহার করা হয়েছে। এ ধরনের অস্ত্র সাধারণত যুদ্ধের সময় ব্যবহার করা হয়।
সেরাম রোজেশ বলেন, মইরাংয়ে আমার বাড়ি। একটা শান্ত জায়গায় এইভাবে হামলা চালানো হয়েছে ভেবেই শিউরে উঠছি। ঘটনায় যার মৃত্যু হয়েছে তিনি মেইতেইয়ের একজন প্রবীণ সদস্য। তাকে এভাবে প্রাণ দিতে হলো এই বিষয়টা খুবই দুঃখের।
পুলিশ সন্দেহ করছে, বোমার বিস্ফোরণে ওই প্রবীণ ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে সেটি ছোড়া হয়েছিল সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মাইরেমবাম কোইরেঙের বাড়িকে লক্ষ্য করে। কাছাকাছি একটি জায়গায় ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ওই প্রবীণ। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়েছে। একাধিক জায়গায় গত সপ্তাহে একইরকমের বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে বলে অভিযোগ।
শুধু তাই নয়, পুলিশ জানিয়েছে ৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় মণিপুর রাইফেলসের দুটি ব্যাটেলিয়নের অস্ত্রাগার লুট করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সেখানে মোতায়েন যৌথ বাহিনী তা রুখতে সমর্থ হয়। হামলাকারীদের রুখতে কাঁদানে গ্যাসের শেল এবং শূন্যে গুলি ছোড়া হয়। এদের মধ্যে একদল হামলাকারী পুলিশের ওপর আক্রমণ চালায় যাতে দুজন পুলিশকর্মী আহত হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতি: বর্তমান পরিস্থিতির প্রভাব জনজীবনে পড়েছে। রাস্তা-ঘাটে অতিরিক্ত পুলিশ এবং নিরাপত্তাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে কয়েকদিন। বহু এলাকায় দোকানবাজার বন্ধ রয়েছে। রোববার রাজ্যপাল এল আচার্যের সঙ্গে দেখা করেন মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং। তার সঙ্গে ছিলেন ১৮ জন বিধায়ক।
এদিকে, সোমবার সকালে ইম্ফলে পুলিশের ডিজি, নিরাপত্তা উপদেষ্টা-সহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ইস্তফার দাবিতে রাজভবনের দিকে রওয়ানা দেয় মণিপুরের স্কুল এবং কলেজের কিছু পড়ুয়া। এর পাশাপাশি আধাসামরিক বাহিনী প্রত্যাহার এবং নৈতিক কারণে ৫০ জন বিধায়কের পদত্যাগও দাবি করেন তারা। রাজভবনের সামনে অবস্থান বিক্ষোভও করেন।
ধনমঞ্জরি স্টুডেন্ট ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক বার্তা সংস্থা এএনআইকে বলেন, খাঁচায় থাকা আর ইম্ফলে থাকার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই এই বার্তা বোঝানোর জন্য আমরা মিছিল করছি। কুকিরা জানিয়েছে তাদের কাছে যে অস্ত্র রয়েছে তা দিয়ে তারা ২০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুকে নিশানা করতে পারে। তাই কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে অবিলম্বে হস্তক্ষেপের দাবি জানাচ্ছি। একইসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর হাতে সমস্ত ক্ষমতা তুলে দিয়ে ইউনিফায়েড কমান্ড জারি করার কথাও জানাচ্ছি।
অন্যদিকে, মুখ্যমন্ত্রীর ইস্তফা দাবি করেও সোচ্চার হয়েছেন অনেকেই। রোববার রাতে বহু নারী রাস্তায় নেমে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তার ইস্তফা দাবি করেছেন। অন্যদিকে, কুকি সম্প্রদায় এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক সহিংস সংঘর্ষে অত্যাধুনিক অস্ত্রের ব্যবহার চিন্তার কারণ বলেই পুলিশ ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
সুত্রঃ যুগান্তর
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |