
নানা নাটকীয়তা ও দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে ঘোষিত হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ তথা জাকসু নির্বাচনের ফলাফল। ডাকসুর পর জাকসুতেও প্রায় একচেটিয়া বিজয় পেয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। জাকসু ও হল সংসদগুলোয় যারা জয়ী হয়েছে তাদের সবাইকে আন্তরিক অভিনন্দন। অভিনন্দন তাদেরও, যারা আখেরে জয়ী না হলেও বিভিন্ন প্যানেল থেকে কিংবা স্বতন্ত্রভাবে এ ভোট যুদ্ধে শরিক হয়ে পুরো আসরটি মাতিয়ে রাখতে ভূমিকা রেখেছে।
একটি নির্বাচনে হারজিত থাকবেই। তবে, কারা কীভাবে জিতে এলো সেটা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই সবার মধ্যে বিশেষ ঔৎসুক্য কাজ করে। ’৮০-এর দশকের শেষ থেকে শুরু করে প্রায় ৩৫ বছর যে সংগঠনটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) অনানুষ্ঠানিকভাবে একরকম নিষিদ্ধ ছিল, সেটি কীভাবে এ নির্বাচনে প্রধান শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হলো? জুলাই ছাত্রলীগকে ‘নাই’ করে দিয়েছে, কিন্তু ছাত্রদল কেন তার শূন্যতা পূরণ করতে পারল না? জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্ররাজনীতিতে বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর একটি বড় ভূমিকা ছিল। কেন তারাও জুলাইয়ের এ পরিবর্তনকে নিজেদের পক্ষে কাজে লাগাতে পারল না? অথচ জুলাইয়ে আওয়ামী লীগ/ছাত্রলীগ বিতাড়নে তারা সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে।
তাহলে শিবির কীভাবে মাঠের দখল নিয়ে নিল? এটা কি সেই খরগোশ আর কচ্ছপের গল্প? হতে পারে। তবে মূল কারণ বোধহয় অন্যখানে। এটা বুঝতে হলে যেসব আশা-আকাঙ্ক্ষা এদেশের তরুণদের দীর্ঘ ফ্যাসিস্ট রেজিমের অবসানে মাঠে নামিয়েছিল এবং অকাতরে পুলিশের বুলেটের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল সেগুলো আমাদের সামনে রাখতে হবে। ফ্যাসিস্ট সরকারের ছাত্রসংগঠন ক্যাম্পাসে যে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছিল, গেস্টরুম-গণরুম কালচার চালু করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বাধীন চিন্তা ও চলাচলকে অসম্ভব করে তুলেছিল, জুলাই-পরবর্তী স্বাধীন জীবন তাদের মুক্তভাবে বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ এনে দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের একটি বড় আশঙ্কার জায়গা ছিল, সেই দুঃস্বপ্নের দিনগুলো ফের কোনোরূপে ফিরে আসবে না তো?
শিক্ষার্থীরা একটি নিরাপদ ক্যাম্পাস যেমন চেয়েছে, তেমনই তারা এখানে দুর্নীতি-অনিয়মের মূলোৎপাটন চেয়েছে। ফাও খাওয়া, দোকানপাট থেকে বখরা আদায়, সরকারি ক্রয় ও নির্মাণকাজে কমিশন বাগানো-এসব হয়ে দাঁড়িয়েছিল এদেশে ছাত্ররাজনীতির একটি প্রধান চরিত্র। শিক্ষার্থীরা চায়নি, আবার কেউ নেতৃত্বের আসনে বসে ফের ওই কাজগুলো শুরু করুক। তারা এমন কাউকে নেতৃত্বে দেখতে চেয়েছে, যারা শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন সমস্যাগুলো সমাধানে কাজ করবে, যারা তাদের অধিকারের পক্ষে কথা বলবে, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ নিশ্চিতে প্রশাসনকে সহযোগিতার পাশাপাশি প্রয়োজনমাফিক প্রশাসনের ওপর চাপ প্রয়োগ করবে।
এছাড়া আরও একটি বিষয় এ নির্বাচনে বড় নিয়ামক হয়ে থাকতে পারে। এদেশের সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আমূল সংস্কার ও ভারতীয় আধিপত্যের স্থায়ী বিলোপ চায়। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী বিগত এক বছর এ ক্ষেত্রে কোনো দল কীরকম ভূমিকা রেখেছে, তা তারা সতর্কভাবে খেয়াল করেছে। দেশে পুরোনো ব্যবস্থা বহাল রাখতে চায় কিংবা ভারতীয় আধিপত্যের প্রশ্নে নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে চায়, এদেশের ছাত্রসমাজ এমন কোনো শক্তিকে ফের মসনদে দেখতে আগ্রহী নয়।
আমার ধারণা, মোটা দাগে এ বিষয়গুলো নির্বাচনে নেতৃত্ব বাছাইয়ের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মননে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসাবে কাজ করেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে কোনো কোনো সংগঠনের ছাত্রসংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে অনাগ্রহ ও বিরোধিতা। নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে এবং নির্বাচন চলাকালে ম্যানিপুলেশন এবং বিভিন্ন কায়দায় নির্বাচন ভন্ডুলের চেষ্টা শিক্ষার্থীদের মনে গভীর দাগ কেটেছে।
নিরাপদ ক্যাম্পাস, সৎ নেতৃত্ব, শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে আপসহীন ভূমিকা এবং জুলাইয়ের স্পিরিটে দেশের সংস্কার ও ভারতীয় আধিপত্যের স্থায়ী বিলোপ-এসব বিবেচনায় এ মুহূর্তে কারা হতে পারে তাদের কান্ডারি? কোনো প্ল্যাটফর্ম তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার রূপায়ণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে? ছাত্রদল, ছাত্রশিবির, বাগছাস, নাকি বাম সংগঠনগুলো? গত এক বছরের কার্যক্রম দেখে এবং পুরোনো ইতিহাস সামনে রেখে শিক্ষার্থীরা কি তাহলে এখনকার মতো একটি সংঘবদ্ধ শক্তি হিসাবে ছাত্রশিবিরের ওপর তাদের আস্থা রাখতে চেয়েছে? বাকিরা কমবেশি ইতোমধ্যে পরীক্ষিত হয়েছে, এবার শিবিরকে একটি সুযোগ দিয়ে পরখ করা যেতে পারে-এই বিবেচনাটাও কি একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসাবে কাজ করেছে? ডাকসু নির্বাচনের ফলাফলও এখানে নিশ্চিতরূপে একটি বড় প্রভাবক হিসাবে ভূমিকা রেখে থাকবে।
নির্বাচনের ফলাফলে একটি গুরুত্বপূর্ণ টুইস্ট ছিল, ভিপি পদে শিবির-সমর্থিত প্রার্থীর হেরে যাওয়া। প্রায় সব পদে যেখানে শিবির একচেটিয়াভাবে জিতে এসেছে, সেখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদটিতে শিবির হেরে গেল কেন? এটা কি সঠিক প্রার্থী বাছাইয়ে দুর্বলতা? নাকি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর জুলাই আন্দোলনে চোখে পড়ার মতো ভূমিকা? তবে একটি বিষয় তো নিশ্চিতরূপেই বলা যায়। সেটা হলো, এ পদের ওপর সবার কড়া নজর ছিল। শিবির-সমর্থিত প্রার্থী সেই চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাছাড়া নির্বাচনি ফলাফল থেকে এটা স্পষ্ট, এখানে একরকম ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে, যা স্বতন্ত্র কিন্তু নিজস্ব কীর্তিতে উজ্জ্বল প্রার্থী আবদুর রশীদ জিতুকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেছে।
সামগ্রিকভাবে শিক্ষার্থীরা এবারের জাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের ওপরেই আস্থা রেখেছে। শিবির কি পারবে তাদের ওপর অর্পিত এ গুরুদায়িত্বের যথাযথ মর্যাদা দিতে? আরও একটি বিষয়-প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলো যারা এ ভোটযুদ্ধে হেরে গেছে, তারা শিবিরকে সদা সতর্ক পর্যবেক্ষণে রাখবে এবং নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে কার্পণ্য করবে না। শিবির যদি শিক্ষার্থীদের আশা-আকাঙ্ক্ষা রূপায়ণে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে সতর্ক পদক্ষেপে এগিয়ে যায় এবং সমালোচকদের বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করে তাদের সমালোচনাকে অ্যাড্রেস করতে সচেষ্ট হয়, তাহলে আল্লাহর সাহায্য নিশ্চয়ই তাদের সঙ্গে থাকবে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এ যাত্রা সফল হোক এবং তাদের কর্মতৎপরতায় এ ক্যাম্পাস মুখরিত হয়ে উঠুক এ প্রত্যাশা থাকল।