জাতীয়: চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে গত ৫ ফেব্রুয়ারি মারা যান চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার বাসিন্দা রুবেল দে (৩৮)। তবে বিনা চিকিৎসা ও কারা কর্তৃপক্ষের নির্যাতনে তার মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেছেন পরিবার। হত্যার অভিযোগ করে ২০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলা করেন রুবেলের স্ত্রী পূরবী পালিত।
মামলায় আসামি করা হয় চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার (ভারপ্রাপ্ত) মুহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন ও জেলার মোহাম্মদ এমরান হোসেন মিঞাসহ ১৬ জনকে। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের আদেশ দেন।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন কারাগারের ডেপুটি জেলার নওশাদ মিয়া, মো. আখেরুল ইসলাম, সুমাইয়া খাতুন, ইব্রাহিম এবং কারাগারের ১৫ নম্বর ওয়ার্ড মাস্টার, বোয়ালখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ থানার অন্য কর্মকর্তারা।
মামলার অভিযোগে রুবেলের স্ত্রী পূরবী পালিত বলেন, ‘রুবেল কারাগারের ৩ নম্বর পদ্মা ওয়ার্ডে বন্দি ছিলেন। কারাগারের ভেতর কারারক্ষী বা অন্য বন্দিরা তাকে নির্যাতন করেছেন। এ কারণে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর রুবেলের শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। কারাগারে আনার আগে রুবেলকে বোয়ালখালী থানা পুলিশও নির্যাতন করেছে বলে অভিযোগ করা হয়।’
এ ঘটনার রেশ না কাটতেই চট্টগ্রাম কারাগারে রহস্যজনক মৃত্যু হয় সাজাপ্রাপ্ত বন্দি মো. ইব্রাহিম নেওয়াজের (৩০)। সোমবার (১৮ মার্চ) রাতে কারাগারের ভেতরে চৌবাচ্চার টিনের চালের আড়ার সঙ্গে ফাঁস লাগানো অবস্থায় তাকে উদ্ধার করা হয়। পরে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নেওয়া কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
নিহত ইব্রাহিম নেওয়াজ রাঙামাটি জেলার পৌর সদরের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মো. আলী নেওয়াজের ছেলে। রাউজান থানার একটি অস্ত্র মামলায় ১০ বছরের সাজা হয় তার। গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর আদালত তাকে চট্টগ্রাম কারাগারে পাঠান। কারাগারের যমুনা-১৯ নম্বর ওয়ার্ডে থাকতেন তিনি। তার কয়েদি নম্বর ৭৯৫৩/এ।
ইব্রাহিমের স্বজনদের অভিযোগ, চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দিদের নিয়ে বাণিজ্য চলছে। বন্দিদের জিম্মি করে, কষ্ট দিয়ে আদায় করা হয় টাকা। টাকার জন্যই ইব্রাহিমকে পরিকল্পিতভাবে কারাগারের ভেতরে খুন করা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির দাবি করেন তারা।
ইব্রাহিম নেওয়াজের মামাতো ভাই নাইমুর রহমান তুর্য বলেন, ‘কারাগারের ভেতর ইব্রাহিম নেওয়াজ আত্মহত্যা করেছে বলে ফোন করে কারাগার থেকে আমাদের জানানো হয়। আমরা এসে লাশ দেখি। কারাগারের ভেতর কীভাবে মানুষ আত্মহত্যা করেছে, বিষয়টি আমাদের কাছে রহস্যজনক। তাকে নির্যাতন করে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হতে পারে। আমরা এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করছি।’
তবে কারা কর্তৃপক্ষ দাবি করে বলেছে, পারিবারিক অশান্তি থেকে ইব্রাহিম নেওয়াজ গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু ইব্রাহিমের মৃত্যুর পর দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগে তিন কারারক্ষীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তারা হলেন এরশাদ উল্লাহ, হাবিবুর রহমান ও আল আমিন।
এ ঘটনায় ১৯ মার্চ সকালে কারা কর্তৃপক্ষ নগরীর কোতোয়ালি থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করেছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম ওবায়েদুল হক।
কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শামসুল ইসলাম জানান, সোমবার ৭টা ৪০ মিনিটে ইব্রাহিম নেওয়াজকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায় কারা কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. মহিন উল্লাহ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানান, তাকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছে।
ইব্রাহিমের মৃত্যুর কারণ তদন্তে কারা কর্তৃপক্ষ চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এতে প্রধান করা হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগের কারা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি, প্রিজন) টিপু সুলতানকে। বিভাগের তিন জেলা কারাগারের জেল সুপারকে রাখা হয়েছে কমিটির সদস্য হিসেবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে কারা অধিদফতর।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান রাউজান উপজেলার যুবদল নেতা আবদুল খালেক। কারাগারের পরিস্থিতি বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কারাগারে টাকার জন্য বন্দিদের নির্যাতন করা হয়। এখানে বন্দি বেচাকেনা হয়। বন্দিদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন করে টাকা আদায় করা হয়। আর যাদের টাকা আছে, তারা কারাগারে রাজার হালে থাকে। চট্টগ্রামের এক শিল্পপতির ছেলেও কারাগারে আছে রাজার হালে। তার যা প্রয়োজন, সবই বাইরে থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সাধারণ বন্দিরা থাকেন কষ্টে।’
তিনি আরও বলেন, ‘চট্টগ্রাম কারা হাসপাতালে অসুস্থ রোগীদের থাকার কথা থাকলেও, হাসপাতালে থাকছে অধিকাংশ সুস্থ বন্দি। টাকার বিনিময়ে তাদের অসুস্থ সাজিয়ে কারা হাসপাতালে থাকার সুযোগ করে দেয় কারা কর্তৃপক্ষ।’
অভিযোগ বিষয়ে জানতে চেয়ে গতকাল বুধবার (২০ মার্চ) বিকালে ও বৃহস্পতিবার (২১ মার্চ) সকালে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার (ভারপ্রাপ্ত) মুহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন ও জেলার মোহাম্মদ এমরান হোসেন মিঞার মোবাইল ফোনে এই প্রতিবেদক একাধিকবার কল করেছেন। তারা রিসিভ করেননি। বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে একাধিকবার কল দিলেও তারা ধরেননি।
এ নিয়ে চট্টগ্রাম বিভাগের কারা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি, প্রিজন) টিপু সুলতান বলেন, ‘কারাগারে এক সাজাপ্রাপ্ত বন্দি আত্মহত্যা করেছেন। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তে চার সদস্যের কমিটি করেছে কারা অধিদফতর। তদন্ত শেষ হলে জানা যাবে কীভাবে বন্দির মৃত্যু হয়েছে।’
যা বললেন বিশেষজ্ঞরা
সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজে কারাগারকে বলা হয় সংশোধনাগার ও নিরাপদ স্থান। বাইরে অপরাধ করলে কারাগারে পাঠানো হয় সংশোধন হওয়ার জন্য। অপরাধ ছেড়ে ভালো হওয়ার জন্য। নিরাপদ কারাগার এখন অনেক বেশি অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। কারাগারে একের পর এক অস্বাভাবিক মৃত্যু কিছুতেই কাম্য নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আগে মনে করতাম কারাগারে কর্মরতরা বেতনের টাকায় নির্ভরশীল। চট্টগ্রাম কারাগারের জেলার সোহেল রানা বিপুল পরিমাণ টাকাসহ গ্রেফতারের পর জানা গেলো, বন্দিদের থেকে এখানে টাকা আদায় করা হয়। বেতনের টাকা ছাড়াও অবৈধ আয়ের উৎস আছে। কারাগারের ভেতর ক্যানটিনে জিনিসপত্রের দাম নাকি বাইরের থেকে অনেক বেশি। সভ্য সমাজ বিনির্মাণে কারাগার কোনও ভূমিকাই রাখতে পারছে না। এভাবে চলতে থাকলে এর কোনও সুফল পাবে না দেশের জনগণ।’
চট্টগ্রাম মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক বেসরকারি কারা পরিদর্শক মো. আজিজুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কারাগারে আটক বন্দিদের নিয়ে এখন নানা অভিযোগ উঠছে। সব অভিযোগের তীর কারা কর্তৃপক্ষের দিকে। গত তিন বছর ধরে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বেসরকারি কারা পরিদর্শক নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। বেসরকারি কারা পরিদর্শক থাকলে কারা কর্তৃপক্ষের বাইরেও পৃথক মনিটরিং করা যায়। এখন কারা কর্তৃপক্ষ তাদের মতো করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইদানীং বন্দির মৃত্যু নিয়ে যেসব অভিযোগ উঠেছে, তা কতটুকু সঠিক আমার পক্ষে বলা মুশকিল। তবে এ ধরনের অভিযোগ যাতে না ওঠে, সে ক্ষেত্রে কারা কর্তৃপক্ষকে আরও সজাগ হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।’
২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার টাকা, আড়াই কোটি টাকার ব্যাংক এফডিআর, এক কোটি ৩০ লাখ টাকার বিভিন্ন ব্যাংকের চেক এবং ১২ বোতল ফেনসিডিলসহ গ্রেফতার হন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের তৎকালীন জেলার সোহেল রানা বিশ্বাস। এ ঘটনায় ভৈরব রেলওয়ে থানা পুলিশ বাদী হয়ে মাদক ও মানি লন্ডারিং আইনে পৃথক দুটি মামলা করেন। এসব টাকা চট্টগ্রাম কারাগারে আটক বন্দিদের নির্যাতনের মাধ্যমে আদায় করার অভিযোগ উঠেছিল।
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |