সারাদেশ: নতুন স্পন্দন, নতুন আশা, নতুন সম্ভাবনাকে সামনে নিয়ে শুরু হয় নতুন বছর। আর এই নতুন বছরের প্রথম দিন থেকেই রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে ভাড়াটিয়াদের বাসা পরিবর্তনের চিত্র। কোনো ভাড়াটিয়া পিকআপে করে, কেউ ট্রাকে, কেউ কেউ ভ্যানগাড়িতে মালামাল নিয়ে বাসা পরিবর্তন করে অন্য এলাকায় চলে যাচ্ছেন। নতুন বছরের শুরু থেকেই এ চিত্র বেশি চোখে পড়ছে। কী কারণে তাদের বাসা পরিবর্তন; জানতে চাইলে অধিকাংশ জানিয়েছেন— বেড়েছে বাসা ভাড়া, যা বহন করা কষ্টসাধ্য। তাই তারা একটু দূরে বা ভেতরের দিকে চলে যাচ্ছে, যেখানে ভাড়া তুলনামূলক একটু কম। ভুক্তভোগীদের একজন রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা সাব্বির আহমেদ। চাকরি করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়া থাকেন শেওড়াপাড়া এলাকার একটি বাসায়। তৃতীয় তলার সেই ফ্ল্যাটে ভাড়া দেন ১৪ হাজার টাকা। বছরের শুরুতেই তিনি বাড়ির মালিকের কাছ থেকে ভাড়া বাড়ানোর নোটিশ পেয়েছেন। বলা হয়েছে— আগামী মাস থেকে ভাড়া বাড়বে এক হাজার টাকা। এর ফলে শুধু বাড়ি ভাড়া দাঁড়াবে ১৫ হাজার টাকা। সেই সঙ্গে গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, ময়লার বিল সবমিলিয়ে যুক্ত হবে আরও প্রায় তিন হাজার টাকা। অর্থাৎ তার ভাড়া বাসা কেন্দ্রিক খরচ বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ১৮ হাজার টাকা। অথচ মাস শেষে তিনি বেতন পান ৩০ হাজার টাকা। অর্থাৎ তার আয়ের সিংহভাগ চলে যাচ্ছে বাসা ভাড়া পরিশোধে। এছাড়া বর্তমান ঊর্ধ্বগতির বাজারে সংসার পরিচালনা করতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে সাব্বির আহমেদকে। তার সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হলো বাসা ভাড়া বৃদ্ধির খড়গ।
সবমিলিয়ে সাব্বির আহমেদ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন— সামনে দুই-এক মাসের মধ্যে বাসা ছেড়ে দেবেন, চলে যাবেন আফতাব নগরের একেবারে ভিতরের দিকে। এ অবস্থা শুধু সাব্বির আহমেদের একার নয়। রাজধানীর বড় একটি জনগোষ্ঠী এ সমস্যার মুখোমুখি।
সাব্বির আহমেদ বলেন, আমার অফিস কারওয়ান বাজার। সেখান থেকে দূরে শেওড়াপাড়া এসে বাসা ভাড়া নিয়েছিলাম খরচ কমের জন্য। প্রথমে ১০ হাজার টাকায় ভাড়া বাসায় উঠেছিলাম, কয়েক বছরে ভাড়া বেড়ে ১৪ হাজার টাকা হয়েছিল। এখন আবার ভাড়া বাড়িয়ে ১৫ হাজার টাকা করতে চায় বাসার মালিক। যেটা আমার পক্ষে বহন করা খুব কঠিন। আমার মতো যারা কম টাকার বেতনের চাকরির উপর নির্ভরশীল তাদের জন্য এতো টাকা বাসা ভাড়া দেওয়া খুব কষ্টের। তিনি আরও বলেন, বর্তমান বাজারে সবকিছুর দাম এতটা বেশি যে প্রতি মাসেই চলে টানাপোড়েন। এর মধ্যে বাসা ভাড়া বাড়ানোর নোটিশ যেন আমার জন্য মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে এ এলাকা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আফতাবনগরের একদম ভেতরের দিকে ১১ হাজার টাকায় একটি বাসা দেখেছি, সেদিকেই চলে যাব। সেখান থেকে চলাচলে কষ্ট হবে ঠিকই কিন্তু কিছু করার নেই। বর্তমান অবস্থায় বাসা ভাড়া পরিশোধ করতে করতে আমি দিশেহারা। শুধু সাব্বির আহমেদ নয়, রাজধানীতে বসবাসকারী মধ্যম ও নিম্ন আয়ের মানুষের সবার বলতে গেলে একই সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। একাধিক ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জীবনযাত্রার ব্যয় ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা অবস্থা। সেই সঙ্গে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধিতে অসহায় হয়ে পড়েছেন মধ্যম ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা। যে কারণে কম ভাড়ার আশায় একটু দূরে বা ভেতরের দিকে বাসা স্থানান্তরের প্রবণতা বেড়েছে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ বিষয়ক সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী— গত ১৫ বছরে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ছয় গুণের বেশি, যা শতাংশ হিসেবে দাঁড়ায় ৬২৮। এছাড়া গত ২৫ বছরে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪০০ শতাংশ। একই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অর্থাৎ এ সময়ে নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির হার দ্বিগুণ। সংগঠনটির আরেক পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকার ২৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ, ৫৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া প্রায় ৫০ শতাংশ, ১২ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ টাকা বাসা ভাড়া পরিশোধে ব্যয় করেন। মূলত, চাকরি করতে আসা অথবা বেকার, ভাগ্যান্বেষী, বিদ্যান্বেষীসহ নানা শ্রেণির মানুষের ‘স্বপ্ন গড়ার শহর’ এই রাজধানী ঢাকা। সেজন্য দিন দিন এই নগরে মানুষ বাড়ে জ্যামিতিক হারে। এই সিংহভাগ মানুষের বাসস্থানের চাহিদা পূরণ করতে হয় ভাড়া বাসার মাধ্যমে। কিন্তু এই বড় অংশের মানুষগুলো অসহায় হয়ে থাকে বাড়ির মালিকদের কাছে। নতুন বছরসহ নানা অজুহাতে তারা বাসা ভাড়া বাড়িয়ে দেন। এছাড়া ভাড়ার তুলনায় বাড়ির সেবা, পরিবেশ কখনোই পায় না এসব অসহায় ভাড়াটিয়ারা। বাড়ির মালিক একপ্রকার জিম্মিদশায় রাখেন বলেও অভিযোগ রয়েছে ভাড়াটিয়াদের। দেশে বাড়ি নিয়ন্ত্রণের একটি আইন আছে, যেটি ১৯৯১ সালের। এই আইনে ভাড়াটিয়াদের স্বার্থ রক্ষার কথা বলা হয়েছে। যদিও আইন আছে কিন্তু তার প্রয়োগ নেই খাতে। ভাড়াটিয়াদের স্বার্থ রক্ষার নানান বিষয় এখানে উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে আইনটির প্রয়োগ নেই। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে— ঢাকায় বর্তমানে আড়াই কোটিরও বেশি মানুষের বসবাস। প্রতি বছর রাজধানীতে ছয় লাখ ১২ হাজার মানুষ যুক্ত হচ্ছেন। এক দিনের হিসাবে এক হাজার ৭০০ জন। পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহরগুলোর তালিকায় অন্যতম স্থানে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। আয়তন ও জনসংখ্যার হিসাবে ঢাকা পৃথিবীর ঘনবসতিপূর্ণ একটি শহর। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৪৩ হাজার ৫০০ মানুষ।
ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ২০০৭ সালে শহরের ৭৭৫টি এলাকায় আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প, কাঁচাবাড়ি,পাকা ঘর, সেমি পাকা, মেইন রোডের তিনশত ফিট ভেতরে এবং বাইরে ৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত প্রতি স্কয়ার ফিট ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু এটির প্রয়োগও কোথায় দেখা যায় না। এছাড়া ভাড়া বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৯১ এ রয়েছে সুনির্দিষ্ট বিধান। আইনের ১৬ ধারায় বলা হয়েছে— বড় কোনো ধরনের নির্মাণকাজ বা পরিবর্তন আনা ছাড়া বাসা মালিক দুই বছরের মধ্যে মূল ভাড়া বৃদ্ধি করতে পারবেন না। রাজধানীর বনশ্রী এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে পরিবার নিয়ে ভাড়া বাসায় বসবাস করেন আরেক বেসরকারি চাকরিজীবী মাসুদ রানা। তিনি বলেন, আমার বেতন অনুযায়ী বর্তমান ঊর্ধ্বগতির বাজারে সংসার পরিচালনা করা কঠিন। ইতোমধ্যে অনেক কাটছাঁট করে কোনোমতে টিকে আছি। নতুন করে কাটছাঁট করার আর জায়গা নেই। তাই বাধ্য হয়ে বাসা ছেড়ে মূল শহরের একটু বাইরের দিকে অর্থাৎ বসিলার দিকে চলে যাচ্ছি। সংসার পরিচালনার ক্ষেত্রে এখন প্রতি মাসেই তিন-চার হাজার টাকা আমার ঋণ করতে হয়। অন্যদিকে মিরপুর ১০ নম্বর সংলগ্ন পর্বতা সেনপাড়া এলাকার একটি পাঁচ তলা বাড়ির মালিক হামিদুর রহমান বলেন, আপনারা শুধু মনে করেন বাড়ির মালিকরা শুধু বাসা ভাড়া বাড়িয়েই যায়। কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষাপট ভিন্ন। একজন বাড়ির মালিক সারা জীবনের কষ্টে অর্জিত টাকা দিয়ে বা লোন করে একটি বাড়ি বানায়। বাড়ির নকশা, অনুমোদনসহ নির্মাণ সামগ্রির অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধ করে, ক্ষেত্র বিশেষে বিভিন্ন জনকে চাঁদার টাকা দিয়ে বাড়ি নির্মাণ করা হয়। তখন ওই মালিকের আয়ের এবং ঋণ পরিশোধের একমাত্র উপায় এই বাড়ি ভাড়া থেকেই। এছাড়া সংসার খরচ, বাড়ি সংস্কারের কাজসহ যাবতীয় খরচ এই বাড়ি ভাড়া থেকে মেটাতে হয়। কিন্তু যারা চাকরি করে তাদের বছর বছর বেতন বাড়ে, প্রমোশন হয়। আর যারা ব্যবসায়ী তারা ব্যবসায় লাভ করে, কিন্তু বাড়ির মালিকের এই ভাড়ার উপরে নির্ভর করে থাকতে হয়।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে বাড়িওয়ালারাও হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। যে কারণে এ বছর ঢাকার বেশিরভাগ বাড়ির মালিকরাই অল্প কিছু করে ভাড়া বাড়িয়েছে। বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির সমালোচনা করে ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি মো. বাহারানে সুলতান বাহার ঢাকা পোস্টকে বলেন, নতুন বছর শুরু হলেই বা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণের কথা উল্লেখ করে নিয়মিত বাড়ি ভাড়া বাড়িয়ে আসছে বাড়ির মালিকরা। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন আছে, তবে কেউ মানে না। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন কার্যকর করতে আমরা বারবার সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি, নিজেরা মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছি। তবুও এই অসহায় ভাড়াটিয়াদের কোনো কথা কেউ শুনছে না। এই শহরের ভাড়াটিয়ারাই প্রাণ কারণ ঈদসহ যেকোনো ছুটি আসলে বুঝা যায় ঢাকা শহর কতটা ফাঁকা। অথচ এই ভাড়াটিয়াদের পুঁজি করেই বাড়ির মালিকরা নানা অজুহাতে ভাড়া বাড়িয়ে দেয়। বলতে গেলে বাড়ির মালিকদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে ভাড়াটিয়ারা। তাই একটু কমে বাসা ভাড়া পাওয়ার আশায় অনেকের মূল শহর থেকে একটু দূরে বা ভেতরের দিকে চলে যাচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, নতুন বছর আসলেই ভাড়া বেড়ে যাওয়ার চিন্তায় ভাড়াটিয়াদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। রাজধানীর লাগামহীন বাড়ি ভাড়া রোধে প্রয়োজন আইনের সঠিক প্রয়োগ। ভাড়াটিয়াদের সমস্যা সমাধানে সিটি কর্পোরেশনের মনিটরিংয়ের পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হবে। যেহেতু সিটি কর্পোরেশনের কাছে সব বাড়ির মালিকরাই হোল্ডিং ট্যাক্স দেয়, সেহেতু সিটি কর্পোরেশনই বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |