রানা প্লাজা ধসে গুরুতর আহত হয়ে পরিপাকতন্ত্র বেরিয়ে গিয়েছিল শিলা বেগমের। এখনও পেটে-পিঠে বেল্ট পরে চলতে হয়ে তাকে। সময়ের পরিক্রমায় শরীরে বাসা বেঁধেছে আরও অসুখ। অর্থাভাবে চিকিৎসাও করাতে পারছেন না। পাচ্ছেন না বিচারও। নিজের কষ্টের কথা বলতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত হয়ে তিনি বলেন, আমরা জানি একটা মানুষের অঙ্গহানী হলে কেমন লাগে। আমি এখনও কোনও কাজ করতে পারি না। টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারি না। পেটে টিউমার হয়েছে, অপারেশন না করালে এটা ক্যান্সার হয়ে যাবে বলেছে ডাক্তার। কিন্তু টাকার অভাবে অপারেশন করতে পারছি না। মানুষের কাছে কত সাহায্য চাওয়া যায়? অনেকে আমাকে এমনও বলে যেন আমি দেহ ব্যবসা শুরু করি। এই লজ্জা কই রাখবো?
মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) জাতীয় প্রেস ক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) আয়োজিত ‘রানা প্লাজা ভবন ধস: ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় ১১ বছর’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় নিজের অবস্থা এভাবেই তুলে ধরেন রানা প্লাজায় আহত শিলা বেগম।
শিলার মতো আরও কয়েকজন ভুক্তভোগী নিজেদের দুর্ভোগের কথা বলেন সেখানে। এমনই একজন নিলুফা বেগম। তিনি বলেন, ২৪ এপ্রিল আসলে আমাদের খবর নেওয়া হয়। এছাড়া খবর থাকে না। আমি আমার পা হারিয়েছি। আমি জানি আমার মতো যারা আছে তাদের কী অবস্থা। আমি আমার ছেলেকে পড়াশোনা করাতে পারি নাই। এখন আমার পায়ের যে অবস্থা দেশে এটার আর কোনও চিকিৎসা নাই।
বিচার পাওয়ার আকুতি জানিয়ে নিলুফা বলেন, আজ ১১ বছর হয়ে গেছে আমরা এর কোনও বিচার পাই নাই। আমরা এর বিচাই চাই, মালিকদের বিচার চাই। আর আমরা চাই যেখানে রানা প্লাজা ছিল সেখানে একটা স্মৃতিসৌধ বানিয়ে দেওয়া হোক। যাতে আমরা সেখানে নিহতদের স্মরণ করতে পারি।
আরেক ভুক্তভোগী মিনু বেগম বলেন, রানা প্লাজার ঘটনায় আমার মাথায় আঘাত লাগে। এখন আমি কিছু মনে রাখতে পারি না। আমি এখন কী বললাম সেটা একটু পরে মনে করতে পারি না। আমার মাথায় রক্ত জমাট বেঁধে আছে। মানসিক হাসপাতালে আমার চিকিৎসা চলছে। শুধু এটুকু বলতে চাই, আমরা কারও দয়া বা ভিক্ষা নিয়ে বাঁচতে চাই না।
মতবিনিময় সভায় রানা প্লাজার বিচারের প্রসঙ্গে বক্তব্য রাখেন উপস্থিত অতিথিরা। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার অনীক আর হক বলেন, হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন চারটি রিট মামলা রয়েছে যার কোনোটিরই শুনানি গত বছরের আগে শুরু হয়নি। তার মধ্যেও আমরা আশা করছি খুব শিগগিরই এই রিটগুলোর বিপরীতে উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশনা পাওয়া যাবে। আমরা আশা করছি আগামী কিছুদিনের মধ্যে এই মামলা গুলোর নিষ্পত্তি হবে। কিন্তু দৃষ্টান্ত হওয়ার মতো শক্ত রায় হবে কিনা তা বলতে পারছি না।
রানা প্লাজার মামলায় কেন এত দেরি হচ্ছে তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে রানা প্লাজার ঘটনায় দায়ের করা মামলার অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর, জেলা ও দায়রা জজ আদালত ঢাকার বিমল সমাদ্দার বলেন, ২০১৩ সালে ২৫ এপ্রিল যখন মামলা হয় তখন ২০৩ জন শ্রমিক নিহত হয় বলে উল্লেখ করা হয়। ২০১৬ সালে মামলার চার্জশিট হওয়ার পর ২০১৭ সালে মামলা বিচারের জন্য প্রস্তুত হয়। কিন্তু মামলার চার্জ গঠন হওয়ার পর আসামিপক্ষের আবেদন আমলে নিয়ে হাইকোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়। তাই যেখানে উচ্চ আদালত যেখানে স্থগিতাদেশ দেয় সেখানে আমাদের বিচার আদালতের কিছু করার থাকে না।
বিমল সমাদ্দার বলেন, ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি পর থেকে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। ফৌজদারি মামলাসমূহের ৫৯৪ জন সাক্ষী, যারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাস করছেন। তাদের আদালতে হাজির করাটা অনেক বড় প্রতিবন্ধকতা। আসা-যাওয়ার ভাড়াটাও তাদের হাতে থাকে না। তাদের আদালতে যাতায়াতের ভাতার ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের জন্য কষ্টসাধ্য।
এসময় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ঢাকার সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এম এ আউয়াল বলেন, ঢাকা জজ কোর্টের মামলার ৫৯৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণের প্রতিবন্ধকতা নিরসন করার জন্য শুধু গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ করেও মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব।
মতবিনিময় সভায় সভাপতির বক্তব্য রাখেন ব্লাস্টের আইন উপদেষ্টা এস এম রেজাউল করিম। তিনি আশা প্রকাশ করেন, সব শ্রমিক সংগঠন, সুশীল সমাজ সংগঠনের সহযোগিতায় রানা প্লাজার মামলাগুলো এক যুগ পূর্তির আগেই নিষ্পত্তি হবে।
মতবিনিময় সভা সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ।
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |