প্রচ্ছদ জাতীয় এত দ্রুত তদন্ত পদক্ষেপ আগে দেখেনি ঢাবি

এত দ্রুত তদন্ত পদক্ষেপ আগে দেখেনি ঢাবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম হলে গত বুধবার চোর সন্দেহে শিক্ষার্থীদের পিটুনিতে তোফাজ্জল হোসেন নামে এক যুবক নিহত হন। নিহতের পরিবারের কেউ না থাকায় ওই দিনই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শাহবাগ থানায় একটি মামলা করে এবং হলে সাত সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে, যার প্রতিবেদন সেদিনই সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে হত্যাকাণ্ডে জড়িত আট সদস্যকে চিহ্নিতের কথা উঠে আসে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে এরই মধ্যে তাদের মধ্যে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তারা সবাই হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়ে জেলহাজতে আছেন। ওই আট শিক্ষার্থীকে হল ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার, পাশাপাশি হল প্রভোস্টকেও অপসারণ করেছে প্রশাসন। বাকি জড়িতদের চিহ্নিত করতে কেন্দ্রীয় তদন্ত কমিটি গঠন ও এসব ঘটনা দ্বিতীয়বার যেন না ঘটে, সেই ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

হত্যাকাণ্ডের এই ঘটনার পর এমন সব ত্বরিত পদক্ষেপের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে প্রশংসা কুড়াচ্ছে। স্বাধীনতার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া কোনো অপ্রীতিকর ঘটনায় এত দ্রুত তদন্ত কমিটি করে তার প্রতিবেদন অনুযায়ী কোনো প্রশাসন ব্যবস্থা নিতে পারেনি বলে বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে।

ঘটনার পর এ পর্যন্ত কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে—সে বিষয়ে জানিয়ে গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমদ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন। এতে বলা হয়, তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে হল প্রশাসন অভিযুক্ত ৮ শিক্ষার্থীর আসন বাতিল করেছে; বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অভিযুক্তদের সাময়িকভাবে বহিষ্কার করেছে। অন্য কোনো শিক্ষার্থী জড়িত আছে কি না, তা জানার জন্য আরও একটি কেন্দ্রীয় তদন্ত কমিটি গঠন করার উদ্যোগ নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এর পাশাপাশি পুলিশ প্রশাসনও প্রচলিত আইনে তদন্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছে; জরুরি সিন্ডিকেট সভায় এ রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকানোর জন্য পরবর্তী পদক্ষেপ ও করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

অন্যদিকে, বিভিন্ন নথি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ থেকে এ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে অন্তত ৬০টিরও অধিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। সংশ্লিষ্টদের সূত্রমতে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রভাব বিস্তার, ছাত্র সংগঠনের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি, নারীঘটিত নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে এসব হত্যাকাণ্ড হয়েছে। এসব ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো অপরাধী চূড়ান্ত শাস্তি পায়নি। রাজনৈতিক আশ্রয়ে এসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ায় শেষ পর্যন্ত অপরাধীরা বিচারের আওতায় আসেনি। অনেক মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি পলাতক। কিছু মামলার দণ্ডাদেশ পাওয়া আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরলেও পুলিশ তাদের খুঁজে পাচ্ছে না। কিছু মামলা এখনো তদন্তাধীন বলে জানা গেছে।

গত বছরের ২৫ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসাকেন্দ্রের এক চিকিৎসকের বাসা থেকে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় শিশু গৃহকর্মীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো তদন্ত কমিটিই হয়নি, থানায় মামলাও হয়নি।

চলতি বছরের ৩১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো. মোশাররফ হোসেনের মেয়ে ও মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী আদ্রিতা বিনতে মোশাররফ (২১) ফুলার রোডে ঢাবির আবাসিক কোয়ার্টারে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। এ ঘটনায় আদ্রিতার মা নেদারল্যান্ডস প্রবাসী নুরানী ইসলাম দাবি করেন, তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। এ রকম দাবি থাকা সত্ত্বেও আদ্রিতার লাশ পোস্টমর্টেম করা হয়নি। তবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তৎকালীন সহকারী প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল মুহিতকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও এর প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয় অল্প কিছুদিন আগে। এ প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় কী ব্যবস্থা নিয়েছে, তা আজও অজানা।

গত ২২ এপ্রিল বন্ধুদের সঙ্গে সুইমিংপুলে নেমে মারা যান হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের শিক্ষার্থী সোহাদ হক। ‘সাঁতারে দক্ষ’ থাকা সত্ত্বেও সোহাদের পানিতে ডুবে মৃত্যু নিয়ে তৈরি হয় ধোঁয়াশা। এ ঘটনা খতিয়ে দেখতে তৎকালীন প্রক্টর মাকসুদুর রহমানকে আহ্বায়ক করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেই তদন্তের ফল এখনো জানা সম্ভব হয়নি।

এর আগে, ১৯৭৪ সালে ৪ এপ্রিল রাতে সূর্য সেন হলের সাত শিক্ষার্থীকে অস্ত্রের মুখে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের টিভি রুমে নিয়ে স্টেনগান দিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে বিচার হয় এবং চার বছর পর আদালত শফিউল আলম প্রধানকে মৃত্যুদণ্ড দেন। বাকি আসামিদের দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। কিন্তু জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর আসামিরা সবাই ছাড়া পেয়ে যান।

১৯৭৭ সালে প্রেমসংক্রান্ত বিরোধের জেরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ভূতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী বীরেন্দ্র কুমার সরকারকে হত্যা করে একই হলের শিক্ষার্থী রণজিৎ কুমার মজুমদার। আলোচিত এ হত্যা মামলার ৪৬ বছরেও আসামি গ্রেপ্তার হননি। শেষ হয়নি বীরেন্দ্র হত্যার বিচারও।

১৯৮৩ সালে শিক্ষার্থী ও পুলিশ সংঘর্ষে সাধারণ শিক্ষার্থী জয়নাল, ১৯৮৫ সালে মুহসীন হলের সামনে ছাত্র সমাজের ক্যাডারদের গুলিতে রাউফুন বাসুনিয়া, ১৯৮৬ সালে ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে আসলাম নামের এক শিক্ষার্থী, ১৯৮৭ সালে মুহসীন হলে বোমা বিস্ফোরণে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল হক বাবলু এবং তার দুই সহযোগী মইনুদ্দীন ও নূর মোহাম্মদ, ১৯৮৮ সালে বজলুর রশিদ নামে এক শিক্ষার্থী, ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বরে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সন্ত্রাসীদের গুলিতে ডা. শামসুল আলম খান মিলন, ১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ ক্যাম্পাসে প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপ গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যের কর্মীদের গুলিতে খুন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মঈন হোসেন রাজুসহ অনেকেই বিভিন্ন সময়ে নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া, ২০০৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর মুহসীন হলের বসুনিয়া তোরণের সামনে মোহাম্মদপুর থেকে অপহৃত ইয়াসমিন ও ইসমাইল নামে দুই ব্যবসায়ীর লাশ পাওয়া যায়। ২০০৪ সালের ১৭ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনের গ্যারেজ থেকে উদ্ধার করা হয় এলিফ্যান্ট রোডের চিহ্নিত সন্ত্রাসী শামসুর লাশ। জানা গেছে এসব ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি।

কিন্তু তোফাজ্জল হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে আরবি বিভাগের ২০২০-২১ সেশনের শিক্ষার্থী আব্দুল হাদী তানভীর বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এটি একটি দৃষ্টান্ত বলে মনে হচ্ছে। পরিবর্তনের হাওয়া যে বইছে এবং পরিবর্তন হয়েছে, এটি তার বাস্তব প্রমাণ। আমরা কখনো কল্পনাই করিনি যে, এই প্রশাসন এত দ্রুত তদন্ত কমিটি গঠন করে দোষীদের চিহ্নিত করে, নিজে বাদী হয়ে মামলা করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হবে।

ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী আরাফাত হোসেন ভূঁইয়া বলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এমন কার্যক্রমকে সাধুবাদ জানাই। এই হত্যাকাণ্ড আমাদের গভীরভাবে ব্যথিত ও লজ্জিত করেছে। নতুন বাংলাদেশের ভিত্তি হোক ন্যায়বিচার। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে সর্বাগ্রে মব জাস্টিস বন্ধ করতে হবে। মব জাস্টিসের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ত্বরিত পদক্ষেপ আমাদের আশাবাদী করে। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যবস্থা গ্রহণকে একটি মাইলফলক হিসেবে দেখছি।

মানবাধিকার কর্মী, সমাজ বিশ্লেষক, গবেষক ও ঢাবির শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী কালবেলাকে বলেন, অনুরূপ ঘটনায় বাংলাদেশের ইতিহাসে এত দ্রুততম সময়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তো দূরের কথা। আমরা যারা কনফ্লিক্ট রেজুলেশন এবং মানবাধিকার নিয়ে কাজ করি, তাদের এমনটা আসলে জানা নেই। ২৪ ঘণ্টার আগেই ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির রিপোর্ট প্রদান এবং ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই মূল আসামি ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা অনেক বড় সফলতা। এত দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি প্রশংসার দাবিদার। আমরা আরও খুশি হব তখন, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিরেডিক্যালাইজেশনের পরিবর্তে অ্যান্টি-রেডিক্যালাইজেশন বিষয়ক প্রোগ্রাম চালু হবে। আমরা ধর্মীয়, মতাদর্শিক, শ্রেণিগত, এমনকি সাংস্কৃতিকভাবেও রেডিক্যালাইজড হয়ে যাচ্ছি। তবে আমার কাছে মনে হচ্ছে যে, তোফাজ্জল হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও খতিয়ে দেখা উচিত এই জন্য যে, গ্রেপ্তারকৃতদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা খুব গুরুত্ব বহন করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক মো. লুৎফর রহমান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার জীবনে কোনো ঘটনায় ফজলুল হক হলের ঘটনার এত দ্রুত তদন্ত ও ব্যবস্থা গ্রহণের মতো দেখিনি। তবে আমার মনে হয়, এত বড় একটা কাজের তদন্ত এত সংক্ষিপ্ত সময়ে সম্পন্ন না হওয়াটাই ভালো।

প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমদ কালবেলাকে বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো অঘটনের পুনরাবৃত্তি হতে দিতে চাই না। কোনো অন্যায়কেই ছাড় দেওয়া হবে না। পূর্বের বিতর্কিত সংস্কৃতিকে পেছনে ফেলে নতুন ও একটি সুন্দর বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার স্বপ্ন নিয়ে তা বাস্তবায়নের পথে এগোতে চাই আমরা। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।

সুূত্রঃ কালবেলা

প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে।