প্রচ্ছদ রাজনীতি এক মঞ্চে আসছে বিএনপি-জামায়াত

এক মঞ্চে আসছে বিএনপি-জামায়াত

রাজনৈতিক : সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন আরও জোরদারের লক্ষ্যে বিভিন্ন শরিক দল ও জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে গত পাঁচ দিন ধারাবাহিক বৈঠক করেছে বিএনপি। বৈঠকে যুগপৎ আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি নির্ধারণের আলোচনাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা এসেছে। তবে যুগপৎ আন্দোলনে এবার জামায়াতে ইসলামীকে সম্পৃক্ত করতে বিএনপির অধিকাংশ মিত্র দল ও জোটের শীর্ষ নেতারা জোর পরামর্শ দিয়েছেন। ডান-বাম ও অন্যান্য ইসলামী দল এবং জোটকেও আন্দোলনে যুক্ত করার বিষয়ে বৈঠকে মতামত উঠে আসে। যদিও দু-একটি দল জামায়াতের ব্যাপারে বিরোধিতা করেছে।

এদিকে জামায়াতে ইসলামীও এক মঞ্চে আন্দোলন করার বিষয়ে আগ্রহী। বিএনপির মিত্রদের প্রস্তাব ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন জামায়াতের শীর্ষ নেতারা। শরিকদের প্রস্তাবে বিএনপির মনোভাবও ইতিবাচক। দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা প্রকাশ্যে কিছু না বললেও এসব প্রস্তাব ও পরামর্শ নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা চলছে বলে জানান তারা। তবে যুগপতের দল বা জোট সম্প্রসারিত হোক বা না হোক, শিগগির অভিন্ন দাবিতে আন্দোলনের নতুন রূপরেখা আসতে পারে বলে বিভিন্ন দল ও জোটের দায়িত্বশীল নেতারা জানিয়েছেন।

গত রোববার ১২ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে ধারাবাহিক বৈঠক শুরু করে বিএনপি। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পাঁচ দিনে গণতন্ত্র মঞ্চ, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), গণফোরাম ও পিপলস পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ (নুর), গণঅধিকার পরিষদ (রেজা), বাংলাদেশ লেবার পার্টি (ইরান), এনডিএম, বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির নেতারা। পৃথকভাবে অনুষ্ঠিত বৈঠকগুলোয় যুগপৎ আন্দোলনে জামায়াতকে যুক্ত করাসহ কয়েকটি জোরালো সুপারিশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। সরকার আমদানি নিয়ন্ত্রণ করেও রিজার্ভের পতন ঠেকাতে পারছে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে নিত্যপণ্য। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা হলে বাজার পরিস্থিতির সংকট আরও বাড়বে। তাতে জনগণের ক্ষোভও বাড়বে।

১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক সৈয়দ এহসানুল হুদা ও জোটের শরিক লেবার পার্টির চেয়ারম্যান লায়ন ফারুক রহমান অভিন্ন সুরে কালবেলাকে বলেন, আগামীর আন্দোলনের কী কর্মসূচি নেওয়া যায়, সে বিষয়ে বিভিন্ন আলোচনা-পর্যালোচনা এবং ডান-বাম বিভিন্ন দল ও জোটকে আন্দোলনে যুক্ত করার বিষয়ে বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, শিগগির যুগপৎ আন্দোলনের নতুন রূপরেখা আসবে।

গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি নেতৃত্বাধীন একদফা দাবিতে চলা যুগপৎ আন্দোলনে ভাটা পড়ে। নির্বাচনের পরপরই সমমনা দল ও জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকও শুরু করে বিএনপি। সেসব বৈঠকে যুগপৎ আন্দোলনের ভুলত্রুটিসহ বিভিন্ন বিষয় পর্যালোচনা করা হয়। মাঝপথে ওই বৈঠক মুলতবি হয়। এরপর গত ১২ মে থেকে আবারও শরিকদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করেছে বিএনপি।

বিএনপি নেতারা বলছেন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য ৭ জানুয়ারির একদলীয় নির্বাচন বর্জনকারী সবাইকে নিয়েই জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হচ্ছে। বিএনপির এই জাতীয় ঐক্যের চিন্তার বিষয়ে জামায়াতের সঙ্গে কোনো আলোচনা হচ্ছে কি না—এমন প্রশ্নে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো নেতা মন্তব্য করতে রাজি হননি; বরং রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে তারা জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখেছেন। গত বৃহস্পতিবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আমাদের সামনে আর কোনো বিকল্প নেই। দলমত নির্বিশেষে ভেদাভেদ ভুলে একত্র হয়ে এই সরকারকে সরাতে হবে। আমাদের নিজেদেরই সেটা করতে হবে, আমাদের কেউ করে দিয়ে যাবে না।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, সরকার পতনের অভিন্ন দাবিতে এতদিন ভিন্ন ভিন্ন প্ল্যাটফর্মে থাকলেও খুব দ্রুত এক মঞ্চে উঠবে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। দুই যুগের বেশি সময়ের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কে যে ছেদ পড়েছিল, তার ইতি ঘটতে যাচ্ছে। উভয় দলের মান-অভিমানের বরফ গলতে শুরু করেছে। দুপক্ষের অব্যাহত যোগাযোগে দূরত্ব অনেকটাই কমেছে। বিশেষ করে গত রমজানে উভয় দলের ইফতার মাহফিলে শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতি সেটিই প্রমাণিত হয়েছে। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর গত ২৮ মার্চ বিএনপির উদ্যোগে রাজনীতিকদের সম্মানে আয়োজিত ইফতার মাহফিলে জামায়াতের আমিরসহ চারজন কেন্দ্রীয় নেতার অংশগ্রহণের বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়। পাশাপাশি ৩০ মার্চ রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে জামায়াতে আমিরের উদ্যোগে ইফতারেও বিএনপির বেশ কজন শীর্ষ নেতা যোগ দেন। দীর্ঘ বিরতির পর আবারও এক মঞ্চে পাশাপাশি বসা রাজনীতিতে নতুন বার্তা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কোন্নয়নের জন্য বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেই দেখভাল করছেন। এ নিয়ে দল দুটির কেউ কিছু বলতে চাননি।

এদিকে সম্প্রতি জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ ও কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের একাধিক বৈঠকে দেশের চলমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ সার্বিক বিষয়ে আলোচনা করেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। এসব বৈঠকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার বিষয়ে তাগিদ দেন দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান। সর্বশেষ সরকার পতনের লক্ষ্যে যুগপৎ আন্দোলনকে ইতিবাচক ভাবলেও এখন বৃহত্তর স্বার্থে সবকিছু বিবেচনা করেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন জামায়াতের নীতিনির্ধারকরা। তবে যুগপৎ আন্দোলনে যাওয়া বা না যাওয়ার ব্যাপারে এখনই পরিষ্কার কিছু বলছেন না দলটির নেতারা।

জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বৃহস্পতিবার কালবেলাকে বলেন, ‘অবৈধ, ফ্যাসিবাদী শাসককে সরিয়ে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের কাঙ্ক্ষিত সরকার প্রতিষ্ঠার অভিন্ন লক্ষ্যে আন্দোলনরত দল ও জোটগুলোর ঐকান্তিক এবং উদার মতামতকে আমরা শ্রদ্ধা জানাই। আমরা মনে করি, বিভিন্ন দল ও জোটের রাজনৈতিক বা আদর্শিক ভিন্ন ভিন্ন মত থাকতে পারে। তা সত্ত্বেও একই ইস্যুতে পরিচালিত আন্দোলনে দলগুলোর ঐকমত্য ও সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি আন্দোলনের সফলতার জন্য খুবই প্রয়োজন।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী সবসময় দেশ ও জাতি গঠনে অর্থবহ বৃহত্তর ঐক্য ও সংহতিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। বিভেদ ও সংকীর্ণতা দূর করে ভবিষ্যতের পরিস্থিতি ও সময় হয়তো দেশবাসীকে সেদিকেই নিয়ে যাবে।’

বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কের স্পষ্ট দূরত্ব তৈরি হয় ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডিত জামায়াতের একাধিক শীর্ষ নেতার ফাঁসি এবং কারাবন্দি অবস্থায় মৃত্যু হলেও তখন কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি বিএনপি। মূলত ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর থেকে দল দুটির মধ্যে সম্পর্ক ফিকে হতে শুরু করে। এক পর্যায়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট থেকেই সরে আসে জামায়াত। কেননা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ‘জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট’ নামে নতুন জোট গঠন হলে সেখানে ছিল না জামায়াত। ফলে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব আরও স্পষ্ট হয়। এমনকি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০ দলীয় জোট ভেঙে দিয়ে সমমনা মিত্র দলগুলো নিয়ে যুগপৎ কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। কিন্তু বিএনপি যুগপৎ আন্দোলন ও এর কর্মসূচি নিয়েও জামায়াতের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করায় ক্ষুব্ধ হয় ধর্মভিত্তিক দলটি। তবু যুগপৎ আন্দোলনের শুরুর দিকের দুটি কর্মসূচিতে জামায়াতের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। এরপর আর কোনো কর্মসূচিতে অংশ না নিয়ে নিজস্বভাবে কর্মসূচি পালন করেছে দলটি। আন্দোলন চলাকালেই জামায়াতের আমিরকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় বিএনপি বিবৃতি না দেওয়ায় জামায়াত আন্দোলন থেকে সরে যায়। সেই থেকে দল দুটি অভিন্ন দাবিতে পৃথক অবস্থানে রয়েছে। যদিও ২০২৩ সালের ১৪ আগস্ট আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের নায়েবে আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুতে বিএনপি দলীয়ভাবে শোক জানায়। কিন্তু সেই শোকবার্তায় সাঈদীর রাজনৈতিক পরিচয় উল্লেখ করেনি দলটি।

২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় এবং ২৪ ডিসেম্বর ঢাকার বাইরে যুগপৎ আন্দোলনে নিজেদের অবস্থান জানান দেয় জামায়াত। সেদিন ঢাকার মালিবাগে পুলিশের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। যুগপৎ কর্মসূচির শুরুতে বিএনপির পাশাপাশি জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরাও পুলিশের লাঠিপেটার শিকার হন। অনেকের নামে মামলা হয়েছে এবং গ্রেপ্তারও হন। জামায়াতের আমিরকে গ্রেপ্তার করা হলেও বিএনপি কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তাতেও ক্ষুব্ধ হয় জামায়াত। ফলে বিএনপির নেতৃত্বের প্রতি ‘ক্ষোভ’ এবং ‘অভিমান’ থেকেই জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়। ২০২২ সালের ১২ ডিসেম্বর জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানকে গ্রেপ্তার এবং ৩০ ডিসেম্বর যুগপতের গণমিছিল করতে গিয়ে মালিবাগে জামায়াতের শতাধিক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার ও আহত হন। এ নিয়ে বিএনপি কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। এসব বিষয়ে জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ে ব্যাপক সমালোচনা ও ক্ষোভের জন্ম দেয়। কার্যত এর পরই জামায়াত সিদ্ধান্ত নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচিগুলোতে অংশ নেয়নি। তবে নিজস্ব আঙ্গিকে কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে বিএনপির আগে-পরে মাঠে তৎপর ছিল জামায়াত।

জামায়াতের কয়েকজন দায়িত্বশীল নেতা কালবেলাকে বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বেড়েছে। আশা করা হচ্ছে এটি আরও ভালোভাবে এগোবে।

আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়তে গিয়ে ১৯৯৯ সালের ৩০ নভেম্বর বিএনপি-জামায়াতসহ চারদলীয় জোট গঠিত হয়, যা পরে ২০ দলীয় জোটে রূপান্তরিত হয়। একদফা দাবিতে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন সামনে রেখে ২০২২ সালের ৯ ডিসেম্বর ২০ দলীয় জোট ভেঙে দেওয়া হয়। অবশ্য ওই বছরের ২২ ডিসেম্বর বিলুপ্ত জোটের ১২টি দলের সমন্বয়ে ‘১২ দলীয় জোট’ এবং ২৮ ডিসেম্বর আরও ১১টি দল মিলে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট গঠিত হয়। তাতেও জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি। বরং যুগপৎ আন্দোলনে জামায়াতও পৃথক কর্মসূচি পালন করেছে।