সারাদেশ: ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ভারতে পলায়নকারী স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার দলের নেতাকর্মীদের বক্তব্য ছিল, শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। এটা সেই স্বাধীনতা পরবর্তী স্লোগান ‘এক নেতা এক দেশ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ’ এর মতোই। তাদের স্লোগান ছিল, ‘শেখ হাসিনার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই।’ কিন্তু ৫ আগস্ট নেতার পলায়নে দলের সব শেষ হয়ে গেল। নেতার অনুরাগীরাও পালিয়ে নেতার কাছে চলে যাওয়ার প্রাক্কালে কেউ বা সীমান্তের বনজঙ্গলে ধরা খাচ্ছেন, কেউবা ত্রিপুরা সীমান্তে পাহাড় ডিঙাতে গিয়ে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করছেন। অন্যরা হায় হাসিনা, হায় হাসিনা বলে মাতম করছেন। স্বৈরাচারী দলের হ্যাটট্রিক সাধারণ সম্পাদকের প্রিয় উক্তি ছিল, ‘তলে তলে ভারতের সাথে আপস হয়ে গেছে এবং খেলা হবে।’ রাজা দার্শনিক হলে দেশ চলে কিন্তু মন্ত্রীও যদি দার্শনিক হয় তাহলে দেশ যে অচল হয়ে পড়ে তা প্রমাণ করেছে এ সাধারণ সম্পাদক। তোর ঘোষিত সেই খেলা দেখার সুযোগ জনগণের হয়নি, বরং ছাত্র-জনতা তাকে ভারতে পুশব্যাক করে ১৯৭১ সালের ৫৩ বছর সাত মাস পর স্বাধীনতার স্বাদ দ্বিতীয়বার উপভোগের বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী হয়েছে। ভারত নেত্রীকে ১৯৮১ সালের ১৭ মে বাংলাদেশে পুশইন করার ১৩ দিন পরেই জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রথম জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে শহীদ হন। এর সাথে ওই নেত্রীর বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হওয়ার যোগসূত্র ছিল বলে জনগণ মনে করে। কারণ তার রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হওয়ার পথে একমাত্র বাধা ছিল রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা।
স্বৈরাচারের স্তাবক দলীয় নেতা ও সমর্থক তথাকথিত এলিট গোষ্ঠী স্বৈরাচারীকেও বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য নেতারূপে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। স্বৈরাচারীও নিজেকে সর্বজ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান, জনপ্রিয় শাসক ভাবতেন। নেত্রীর স্তাবকরা সবসময় প্রচার করতেন নেত্রীর আগমন না ঘটলে বাংলাদেশ আঁধারে ডুবে যেত। তাই খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীগণ যেমন যীশুর প্রত্যাবর্তন দিবস পালন করে থাকেন, তেমনি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সমর্থক গোষ্ঠী প্রতি বছর ১৭ মে নেত্রীর দেশে প্রত্যাবর্তন দিবস ঘটা করে পালন করতেন। কিন্তু তারা একবারও ভেবে দেখেননি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ১৯৭১ সালে ২০ হাজার সদস্যের মুক্তিবাহিনী গঠন করে দেশের অভ্যন্তরে থেকেই ৯ মাস যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীনে অনন্য ভূমিকা রাখেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর কাদের সিদ্দিকী ভারতে গিয়ে বাংলাদেশের সীমান্তে সেনাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ায় তার রাজনৈতিক জীবন শেষ হয়ে যায়। তিনি ভারতে হিজরত না করলে হয়তো তাকে দু-তিন বছর কারাগারে থাকতে হতো। শেখ মুজিব ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে বাকশাল প্রবর্তন করায় তার প্রতিবাদে বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানী এমপি ও ব্যারিস্টার মঈনুল ইসলাম এমপি সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। জাসদের মঈনউদ্দিন সরকার এমপি ও আব্দুস সাত্তার এমপি তাদেরকে অনুসরণ করেন।তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ, জাপা ও জামায়াতের ১৪৭ জন এমপি ১৯৯৪ সালে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে ১৭৩ দিন হরতাল ও ৪৫ দিন সর্বাত্মক অবরোধ পালন করে। অথচ পরে প্রথম সুযোগেই শেখ হাসিনা আজীবন ক্ষমতায় থাকার মানসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেন। পরপর তিনটি নির্বাচনে স্বৈরাচারের মনোনীত ও হেরেমের বিরোধী দলের ৯০০ জন প্রার্থীর মধ্যে জয়ী ঘোষিত ৮৯২ জন এমপির মধ্যে একজনও রাজনীতিবিদ না থাকার ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে ৫ আগস্ট। আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থকে স্বৈরাচার মাঘ মাসে চৈত্র মাসের ওয়াজ করতে থাকেন। বিএনপি-জামায়াত আন্দোলন হাইজ্যাক করেছে। এদিকে আন্দোলনকারীগণ যে তার শাহী দরজায় পৌঁছে গেছে তা তিনি বুঝতেই পারেননি। তিনি দেশ শাসন করেছেন হীরক রাজার স্টাইলে।
স্বৈরাচারকে দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় রাখতে জাপা গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখায় এবং ছাত্র আন্দোলনের সমর্থনে তারা সংসদ হতে পদত্যাগ না করায় স্বৈরাচারের সহযোগী হিসেবে তাদেরও বিচার হওয়া উচিত বলে জনগণ মনে করে। জাপা ২০১৪ সালের নির্বাচনে না গেলে শেখ হাসিনার পক্ষে স্বৈরাচারী হওয়া সম্ভব হতো না। আবার ২০২৪ সালের নির্বাচনে না গেলেও সহস্রাধিক ছাত্র-জনতাকে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে স্বৈরাচারকে তাড়ানোর প্রয়োজন পড়ত না। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে নির্বাচন করলে অন্তত ৭০-৮০টি আসন নিয়ে হাসিনা বিরোধী দলের নেতা হতে পারতেন। তাহলে জনরোষের ভয়ে তাকে ভারতে পালাতে হতো না। নকল করে পাস করা ছাত্র যেমন তার বিদ্যার দৌড় কতদূর তা জানে, তেমনি স্বৈরাচার ও জাপাও তাদের জনপ্রিয়তার দৌড় জানত। ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে ২টি দল মিলে জয়ী হলেও দু’টিই ছিল বিতর্কিত জয়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের প্রায় তিন মাস আগে সরকারি কর্মচারীরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান নেয়া সত্ত্বেও নির্বাচনে তারা পেয়েছিল মাত্র ১৪৬টি আসন। আবার ২০০৮ সালের নির্বাচনে দুই বছর আগে ভারতের সমর্থন পেয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল মইনের সহায়তায় এক-এগারো ঘটিয়ে নির্বাচনের জয় নিশ্চিতের জন্য ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির মাধ্যমে জেনারেল মইনকে ম্যানেজ করতে হয়েছিল।
ছাত্র-জনতার পাঁচ-আটের ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরেও স্বৈরাচারের দল ও সমর্থক এলিট গোষ্ঠীর মনোভাবের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। তারা এখনো প্রচার করছে ভারতের সহায়তায় নেত্রী শিগগিরই ক্ষমতায় ফিরে আসছেন। তাই প্রতিবিপ্লব ঠেকাতে তাদের সব সম্পদ জব্দ করা জরুরি। দুদকের তদন্তের শেষে আদালতের মাধ্যমে এটি করা সময়সাপেক্ষ হওয়ায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয়, জেলা ও উপজেলা নেতাদের এবং যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাদের সব সম্পদ আগে জব্দ করা হোক। তারা যদি প্রমাণ করতে পারে এ সম্পদ বৈধভাবে অর্জন করেছে তাহলে ফেরত পাবে। কাজটি দুদকের মাধ্যমে করতে গেলে কিয়ামত পর্যন্ত তা শেষ হবে না। স্বৈরাচার ভারতে বসে প্যাঁচ কষছে। জানা মতে, পিকে হালদারের পাচার করা চার হাজার কোটি টাকা ভারতেই রয়েছে। উপরন্তু ১৫ বছরে যে টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে তার অন্তত ১০ শতাংশ ভারতে পাচার হয়েছে। বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে পাচারকৃত হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যবহৃত হতে পারে। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ অঙ্গসংগঠনের যারা আন্দোলন দমনে পুলিশের সাথে থেকে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে কয়েক শ’ ছাত্র-জনতাকে হত্যা ও কয়েক হাজারকে আহত করেছে এবং গত ১৫ বছর ধরে পুলিশকে অবৈধভাবে ব্যবহার করে জনগণের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হওয়া উচিত। পুলিশের কাজে বাধাদান, থানার ওপর অবৈধ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে পুলিশকে আইনবিরোধী কাজ করতে বাধ্য করা, আন্দোলনকারীদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে তার দায় পুলিশের ওপর চাপানো এসব অভিযোগে পুলিশের বাদি হয়ে মামলা করা তাদের নৈতিক দায়িত্ব। উচ্চ আদালতের ওপর জনগণের আস্থা ফেরাতে যদি বিচারপতিদের পদত্যাগ করতে হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি ও শিক্ষকদের ওপর শিক্ষার্থীদের আস্থা ফেরাতে তাদের আন্দোলনের বিরোধিতাকারী শিক্ষকদের পদত্যাগ নয় কেন? কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শুদ্ধি অভিযান চালানোর প্রয়োজন রয়েছে। কারণ তারাও আওয়ামী লীগের নেতাদের মতো ক্ষমা চাননি। দেশের অভ্যন্তরে স্বৈরাচারের দোসররা লাখ লাখ কোটি নগদ টাকা নিয়ে বহাল তবিয়তে আছেন। ভারত বাংলাদেশে তার আধিপত্য বিস্তারের জন্য যে নেত্রীকে বাংলাদেশে পুশইন করেছিল তিনি ২০ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও জনগণের স্বার্থের অনুকূলে কাজ করেননি। বরং জনগণের ভোটাধিকার হরণ করেছেন। তাই নিপীড়িত ছাত্র-জনতা রক্তক্ষয়ী আন্দোলন করে গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সেই নেত্রীকে ভারতে পুশব্যাক করেছে। তাদের এই অর্জন ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না। ভাবুন তো স্বৈরাচার যদি তার শাসনকাল আরো এক মাস প্রলম্বিত করতে পারত তাহলে দেশ ও জনগণের কী অবস্থা হতো! কাজেই কাণ্ডারি হুঁশিয়ার।
সূত্র: নয়া দিগন্ত
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |