আলোচিত : উৎসবের জাতি বলে কথা। তাই সুযোগ পেলেই উৎসব উৎসব খেলায় মেতে ওঠা আমাদের জাতিগত অভ্যাস। পৃথিবীর অন্য কোনো রাষ্ট্র বা সমাজে এমন বাংলাদেশের প্রচলিত অনেক উৎসবের উপস্থিতি অনুপস্থিত এবং অকল্পনীয়। তারপরও উৎসব চলছে। উৎসব চালানো হচ্ছে। উৎসবে যোগ না দিলে আপনার বা আপনার সন্তানের জন্য সমূহ বিপদ আছে।।
গতকাল (পহেলা জানুয়ারি) সারা বাংলাদেশে বই উৎসব হয়েছে। প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্কুল এবং মাদ্রাসার শিক্ষকেরা ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুলে আসতে হয়েছে। কিছু অভিভাবকও এসেছেন। শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্য বই তুলে দেয়া হয়েছে।
সেখানে সেলফিবাজি হয়েছে। সেই ছবি আবার ফেসবুকে আপলোড করা হয়েছে। স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে নাকি এ নির্দেশনা দেয়া আছে যে অনুষ্ঠানের ছবি ফেসবুকে আপলোড দিতে হবে। চাকরি বাঁচানোর জন্য শিক্ষকদের এসব উৎসবের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড দেয়া ছাড়া কোনো গতি নেই।
জানুয়ারির ৭ তারিখে দেশে নাকি নির্বাচনী ভোট উৎসব হবে। সেই উৎসবের কারণে ভোটের দিন নাকি সরকারি ছুটি থাকবে। মানুষ আনন্দ ও খুশির ঠেলায় সারাদিন ভোট দেবে আর অবসর সময় বসে বাদাম ও চানাচুর খাবে। সঙ্গে চা ও চলতে পারে। বিড়ি এবং পানের কথা নাই বললাম। সিগারেটকে ‘বিড়ি’ বলায় যারা সিগারেটখোর তারা মনে কিছু নেবেন না। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এ নির্বাচন বর্জন করলেও কারো কাছে তা উৎসবের ব্যাপার। সে হিসেবে উৎসবের দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা হতেই পারে। উৎসব প্রিয় মানুষ বলে কথা!
শীতের মৌসুমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে টিএসসি হয়ে যখন শাহবাগ যেতাম, তখন দেখতাম কবিতা উৎসব। জাতীয় কবিতা উৎসবে বড় বড় কবিরা কবিতা আবৃত্তি করছেন আর মানুষকে জ্ঞান দিচ্ছেন। স্বৈরাচার এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য বলছেন। খেয়াল করে দেখি মঞ্চের সামনে কয়েক ডজন মানুষ বসে আছেন। কিন্তু মাইকে আওয়াজ যাচ্ছে অনেক দূর পর্যন্ত। সেই মাইকে জ্বালাময়ী বক্তব্যের মধ্যে একটি উৎসব উৎসব ভাব ছিল।
কেউ কেউ বলেন শীত আসলে বিভিন্ন জায়গায় ইসলামী অনুষ্ঠানের (ওয়াজ) সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। মাওলানা সাহেবরা মানুষকে সঠিক পথে ফিরে আসার জন্য ওয়াজ নসিহত করেন। অনেকেই এসব অনুষ্ঠানের মধ্যে একটা উৎসবের আমেজ খুঁজে পান।
এতো উৎসব নিয়ে কথা বলার সুযোগ নেই। আপাতত বই উৎসব নিয়েই কিছু বলতে হচ্ছে। শিক্ষা তো আমাদের মৌলিক অধিকার। ছেলেমেয়েরা স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় যাবে, সরকার তাদের কিছু বই খাতা দেবে, এখানে উৎসবের কী আছে? এখানে আনন্দ বিনোদনের কী আছে? স্কুল কর্তৃপক্ষকে কেন বাধ্য করা হচ্ছে অনুষ্ঠান করার জন্য? হাতে বই নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা কিসের আনন্দ করবে? নতুন বই পাওয়া কি কোন আনন্দের ব্যাপার? কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড দেওয়া হবে কেন? আমার ছেলে মেয়েকে ফেসবুকে আমি দেখতে চাই না। আমার সে অধিকার আছে। কিন্তু রাষ্ট্র শক্তি প্রয়োগ করে স্কুল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বাচ্চাদের ছবি ফেসবুকে আপলোড করাচ্ছে? কেন? কী লাভ? প্রচারণা! সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর উৎসব।
আমার চার সন্তানের সবাই ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেছে। একজন মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছে। আরেকজন কলেজে পড়ছে। বাকি দুজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ সিলেবাস অনুসারে তাদেরকে বই -খাতা সরবরাহ করেছে এবং করছে। ওরা যখন ক্লাসে যায় তখন তাদেরকে এগুলো ধরিয়ে দেওয়া হয়। উৎসব করে তাদেরকে বই দেয়ার প্রশ্নই উঠে না। ফেসবুকে অনুমতি ছাড়া দেওয়া এখানে একটি ও অমার্জনীয় অপরাধ। কিন্তু কেন এমনটা তারা করছে?
কারণ তাদের (ব্রিটিশ সরকারের) প্রচারণার প্রয়োজন নেই। তারা ভালোভাবেই জানে যে শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। এখানে রাজনীতিকে জড়ানোর কোন সুযোগ নেই। এই শিক্ষাকে সহজলভ্য করার জন্য রাষ্ট্রকে সব কিছুই করতে হবে। এটি কোন দান দক্ষিণার বিষয় নয়। এটি নিয়ে রাজনীতি করার কোন সুযোগ নেই। মানুষকে তার মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে সরকারকেই কাজ করতে হবে। এ কাজ করার মধ্যে উৎসবের কিছু নেই।
বিনামূল্যে বই দেয়াকে কেন উৎসবে পরিণত করতে হলো? উৎসবের জ্বালায় এ জাতির দম এখন প্রায় বন্ধ। সেখানে বই দেওয়াকে উৎসবের হাত থেকে রেহাই দেওয়া এবং কোমলমতি ছাত্র ছাত্রীদের দিয়ে ফেসবুকে ছবি আপলোড করা নিয়ে শিক্ষাবিদ এবং রাজনৈতিক নেতাদের কোন অনুশোচনা করতে দেখি না। নাকি অনুশোচনা ও প্রশ্ন করার নৈতিক বোধও তাঁরা হারিয়ে ফেলেছেন!
ডা: আলী জাহান
কনসালটেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট, যুক্তরাজ্য
সাবেক পুলিশ সার্জেন, যুক্তরাজ্য
alijahanbd@gmail.com
সূত্র : মানবজমিন
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |