‘আমার ছেলেক আনে আমার কাছে দেন। আমার ছেলেক আমি বুকের সঙ্গে আটকামু। আমার ছেলেক আনে দেন আপনারা, আমার একটাই দাবি। আমি আর কিছু চাই না, শুধু ছেলেক চাই। আগে আল্লাহ পরে আপনারা, এমপি-মন্ত্রী, সরকার যাই আছে তাদের কাছে আমার দাবি, আমার ছেলেডাক আমার কাছে আনে দেন। দুনিয়াত আল্লাহ আমাক একটা ছেলেই দিছে, ওইডা নিয়েই আমি দুনিয়াত আছি, আর তিনডা মরেই গেছে, এই ছেলেডা নিয়েই আমি দুনিয়াত থাকবার চাই।’ ছেলের ছবি নিয়ে আহাজারি করে কথাগুলো বলছিলেন ভারতীয় মহাসাগরে জলদস্যুর কবলে পড়া বাংলাদেশি এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজের ক্রু হিসেবে থাকা নাজমুলের মা। পণ্য বহনকারী জাহাজটিতে থাকা ২৩ জন নাবিকের মধ্যে একজন সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার ভদ্রঘাট ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম চরনূরনগরের আবু শ্যামা ও নার্গিস দম্পতির একমাত্র ছেলে নাজমুল। তিনি বাদুল্লাহপুর এমএস অ্যান্ড টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট থেকে ২০১৭ সালে এসএসসি ও ২০১৯ সালে এইচএসসি পাস করেন। এরপর সিরাজগঞ্জ সরকারি ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হওয়ার পরেই চাকরি পেয়ে চলে যান। মাত্র ২৩ বছরের ছেলে মো. নাজমুল হক এলাকায় হানিফ নামেই বেশি পরিচিত। দুই ভাই-বোনের মধ্যে সে বড়। ছোটবেলাতেই মারা গেছে তার তিন ভাই-বোন। মাত্র ২০ বছর বয়সেই জাহাজে ক্রু হিসেবে চাকরি পাওয়ার সুবাদে পরিবারের মুখে ফুটিয়েছে হাসি। কিন্তু জলদস্যুর কবলে পড়ার খবরে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন নাজমুলের বাবা। আর কান্না ও আহাজারিতে ভেঙে পড়েছেন মা নার্গিস খাতুন।
বলছেন নাজমুলের কিছু হয়ে গেলে বাঁচবেন না তারাও। বারবার ছেলেকে ফিরিয়ে আনার আকুতি তার। কী হবে নাজমুলের, কবে ফিরবে নাজমুল? এমন আতঙ্ক ও দুঃখ ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিবেশীসহ এলাকাবাসীর মধ্যেও। বুধবার (১৩ মার্চ) দুপুরে উপজেলার ভদ্রঘাট ইউনিয়নের চরনূরনগর গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় এমন দৃশ্য। এর আগে গতকাল মঙ্গলবার (১২ মার্চ) ইফতারের পর বিষয়টি জাহাজ কোম্পানি থেকে জানার পরই বার বার কান্নায় ভেঙে পড়ছেন নাজমুলের মা। এর কিছুক্ষণ পর শেষবার কথা হয়েছিল ছেলে নাজমুলের সঙ্গেও। তারপর থেকে বন্ধ যোগাযোগ। একমাত্র ছেলের কী হবে এই আতঙ্কে সরকার ও কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার বুকের ধনকে ফিরে পাওয়ার আকুতি জানাচ্ছেন মা। সেখানে ভিড় করেছেন এলাকার অসংখ্য মানুষ।
নার্গিস খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, গতকাল সন্ধ্যায় ইফতারের সময় শিপিং কোম্পানি থেকে ফোন দেয়, ফোনটি আমিই ধরি। তারা বলে, আন্টি নাজমুলসহ অনেককেই জলদস্যুরা ধরেছে, তারা ডাকাতদের কবলে পড়েছে। কিন্তু আপনারা চিন্তা কইরেন না। আপনারা যোগাযোগ করতে পারবেন না কিন্তু আমরা যোগাযোগ করছি ও উদ্ধারের ব্যবস্থা করছি। তখনই আমি তাকে বলেছি বাবা তোমাদের কাছে আবার দাবি আমার ছেলেটাকে বের করে দাও।
তিনি আরও বলেন, এর কিছুক্ষণ পর নাজমুল কল দিয়ে বলে মা, আমাদের ২৩ জনকে আটকে রেখেছে। আমাদের জন্য দোয়া করো। রাতে বিরিয়ানি খেতে দিয়েছে। এরপর দোয়া চেয়ে আমার বুকের মানিক ফোন কেটে দেয়। তারপর থেকে আর যোগাযোগ নেই। নাজমুলের মা বলেন, নাজমুলের আয়েই আমাদের সংসার চলে। মাসে ৯০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পাঠায় নাজমুল। গত মাসেও ৯১ হাজার টাকা পাঠিয়েছে। সে বিয়েও করেনি। তার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। পরে আমাদের মেয়ে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে। নাজমুল অনার্সে ভর্তি হওয়ার পরেই তার চাকরি হয়ে যায়। এরপরই চলে যায়। এর আগেরবার গিয়ে মনে হয় বছর তিনেক ছিল। এরপর এসে আবার মাস তিনেক হলো গেছে। এখান থেকে ঢাকা হয়ে বিমানে দক্ষিণ কোরিয়া গিয়ে ওখান থেকে জাহাজে উঠেছে বলেও জানায় মা।
নাজমুলের মতো একই কোম্পানিতে একই পদে চাকরি পেয়েছে তার ফুফাতো ভাই আল মাহমুদ। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা বিষয়টি সবার আগে অফিসের গ্রুপের মাধ্যমে জেনেছি। গ্রুপে আসা তাদের জাহাজের ভিডিও দেখেই বুঝতে পারি এটা নাজমুলদের জাহাজ। আমি জানলেও তার পরিবারকে বিষয়টি আগেই জানাইনি। গতকাল রাত সাড়ে ১১টার দিকে ওর সঙ্গে আমার সর্বশেষ যোগাযোগ হয়েছে। ও তখন পর্যন্ত বলেছে যে ভালো আছে ও খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো দিয়েছে। আমরা চাই সবাই ভালোভাবে ফিরে আসুক। নাজমুলের প্রতিবেশী আমিরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, নাজমুল খুবই ভালো ছেলে। এখানে পড়াশোনা করা অবস্থাতেই চাকরি হয়ে গেছে। নাজমুল ছাড়া ওদের পরিবারকে দেখার আর কেউ নেই। এর আগে ছোটবেলাতেই নাজমুলের আরও তিন ভাই-বোন মারা গেছে। এখন তার একটা বোন আছে, তারও বিয়ে হয়ে গিয়েছে। স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুস সাত্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, নাজমুলের এই খবর শুনে তার পরিবার খুব ভেঙে পড়েছে। এলাকাবাসী খুব কষ্ট পেয়েছে। আমিসহ এলাকাবাসী চাই সুস্থতার সঙ্গে দ্রুত যার সন্তান তার বুকে ফিরে আসুক।
কামারখন্দের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও ভারপ্রাপ্ত ইউএনও সুমা খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি মিডিয়ার মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পেরেছি। এরপর আমার ডিসি স্যারের সঙ্গে কথা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে যে, অবশ্যই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে যেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাদের উদ্ধার করা যায়। সেই বার্তা ও পরিবারের পাশে যে আমরা আছি এই আশ্বাস দেওয়ার জন্য এসেছি। কামারখন্দ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শহীদুল্লাহ সবুজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি বিষয়টি জানার পর নাজমুলের পরিবারের কাছে যাচ্ছি। তাদেরকে সান্ত্বনা জানাতে ও এটা বলতে যে, আপনারা বিশ্বাস রাখুন সরকার দ্রুত আপনাদের ছেলেকে ফিরিয়ে আনবে। সিরাজগঞ্জ জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার (ডিএসবি) পরিদর্শক (ডিআইও-১) মো. আব্দুর রহিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, নাজমুলের বাড়ি সিরাজগঞ্জে জানা গেলেও তার ঠিকানা ও পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না। তার পাসপোর্ট চট্টগ্রাম থেকে করা। পরে আমি ঢাকার অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করার পর তার পরিচয় ও ঠিকানা নিশ্চিত হতে পারি।
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |