প্রচ্ছদ অপরাধ ও বিচার আমি সাঈদী সাহেব বলছি, আমার একটা ভোট প্রয়োজন

আমি সাঈদী সাহেব বলছি, আমার একটা ভোট প্রয়োজন

মানবিকতার আড়ালে ভয়ংকর প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছেন ‘চাইল্ড এন্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ নামের বৃদ্ধ ও শিশু আশ্রম প্রতিষ্ঠানের কর্নধার মিল্টন সমাদ্দার। তার বৃদ্ধাশ্রমে থাকা অনেক সুস্থ মানুষের রহস্যজনক কারণে হঠাৎ করে মারা যাওয়া এবং তাদের শরীরে কিডনির স্থানে কাটাছেঁড়া দাগের বর্ণনা দিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।

প্রতিষ্ঠান থেকে দাফন করা হয়েছে দাবি করা ৯০০ মরদেহের মধ্যে ৮৩৫টি মরদেহের দাফনের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানের প্রচারণায় দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে মুক্ত হওয়ার মতো প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপনও প্রচার করেছেন তিনি।

শুধু বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নেওয়াদের সঙ্গে নয়, তার প্রতারণার শিকার হচ্ছেন লাখ লাখ সাধারণ মানুষ। প্রতিষ্ঠানের নামে সাধারণ মানুষের থেকে প্রতি মাসে প্রায় কোটি টাকা অনুদান সংগ্রহ করেন তিনি। তার এই অনুদানের সিংহভাগ আসে ফেসবুক ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে।

সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে মিল্টন সমাদ্দারের ব্যক্তিগত আইডিতে ফলোয়ার রয়েছে প্রায় ১১ লাখ। আর ব্যক্তিগত পেইজে ফলোয়ার ১ কোটি ৬০ লাখ।

অন্যদিকে ‘চাইল্ড এন্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ নামে ফেসবুক পেজে ফলোয়ার রয়েছে ৪০ লাখ। সবমিলিয়ে ফেসবুকে মোট ফলোয়ার ২ কোটিরও বেশি। এই ফলোয়ার জোগাড় করতেও ভয়াবহ প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন তিনি।

তার ব্যক্তিগত পেজ (Milton Samadder) থেকে বিভিন্ন সময়ে ফলোয়ার বাড়াতে বিজ্ঞাপন দেওয়া (বুস্ট করা) হয়েছে। এজন্য জামায়াতের সাবেক নেতা ও যুদ্ধাপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত দেলোয়ার হোসাইন সাইদী, হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হক, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট মুরসি, মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানদের মতো ব্যক্তিদের ছবি ও মিথ্যা বক্তব্য ব্যবহার করেছে।

তার পেইজ থেকে ২০২১ সালের ১১ এপ্রিল একটি বিজ্ঞাপন চালানো হয়। সেখানে দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর ছবি দিয়ে লেখা হয়, ‘আমি সাঈদী সাহেব বলছি আগামী সপ্তাহে আমার মুক্তি হতে চলছে আপনার একটা ভোট আমার খুবই প্রয়োজন ডান পাশে ভোট দিন।’

মূলত, ফেসবুক পেইজে লাইক বৃদ্ধির জন্য বিজ্ঞাপন দিলে বিজ্ঞাপনের নিচে ডান পাশে লাইক দিতে বলা হয়। সেখানে যে লাইক দেয় সেই ওই পেজের অনুসারী হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে সে ওই পেজের পোস্টগুলো অন্যদের আগে দেখতে পান। নিজের পেজে লাইক বাড়াতে সাঈদীকে নিয়ে এমন প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন প্রচার করেন মিল্টন সমাদ্দার। বিজ্ঞাপনটিতে তিনি একদিনে ১০০ ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১০ হাজার টাকা খরচ করেন।

পরবর্তীতে তিনি একই বিজ্ঞাপন আরও তিনবার প্রচার করেন। দ্বিতীয়বার ১১ এপ্রিল থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত, তৃতীয়বার ১২ এপ্রিল থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত ও চতুর্থবার ১৩ এপ্রিল থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত। এই তিনটি বিজ্ঞাপনেও তিনি প্রতিটির জন্য ১০০ ডলার করে মোট ৩০০ ডলার খরচ করেন।

একই পেজ থেকে হেফাজত নেতা মামুনুল হকের ছবি দিয়ে একটি বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। ২০২০ সালের ৬ ও ৭ ডিসেম্বর প্রচার করা বিজ্ঞাপনটিতেও ১০০ ডলার খরচ করা হয়। ওই বিজ্ঞাপনে মামুনুল হকের ছবির সঙ্গে লেখা হয়, “মুসলিম রাষ্ট্রে কোনো দিন ইসলাম বিরোধী কোনো কিছু হতে দিব না। যতদিন এক ফোটা রক্তও রয়েছে, ডান পাশে লাইক বাটনে ক্লিক করে ভোট দিয়ে পাশে থাকুন।”


একই বছরের ১৭ অক্টোবর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের কোরআন হাতে একটি ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। ওই বিজ্ঞাপনে লেখা হয়, “জীবন চলে যাবে শেষ রক্ত বিন্দু কণা দিয়ে লড়ে যাব তবু আল্লাহর কিতাবে আচড় লাগতে দিব না। একমত হলে পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন।” এই বিজ্ঞাপনটিতেও তিনি ১০০ ডলার খরচ করেছেন।

মিল্টন সমাদ্দর নিজেকে খ্রিষ্ট্রান দাবি করেন। কিন্তু ২০২১ সালের ২৪ ও ২৫ মে তার পেজে দুইটি বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয় মুসলিম পরিচয়ে। দুটি বিজ্ঞাপনেই তিনি ১০০ ডলার করে মোট ২০০ ডলার খরচ করেছেন। ওই বিজ্ঞাপনে তিনি একজন নারীর ফিলিস্তিনি পতাকা হাতে থাকা একটি ছবি দিয়ে লেখেন, “আমি একজন মুসলিম হিসেবে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা চাই। আপনিও যদি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা চান নিচে ডানপাশে লাইক দিয়ে ভোট দিন।”

২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর মিল্টন সমাদ্দারের পেজে এরদোয়ান, মুরসি, মাহাথির ও ইমরান খানের ছবি দিয়ে একটি বিজ্ঞাপন চালান। ১০০ ডলার খরচ করা ওই বিজ্ঞাপনে লেখা হয়েছে, “জনপ্রিয় এই চার মুসলিম নেতাদের যারা ভালোবাসেন শুধু তারাই লাইক দেন।”

অন্যদিক তার ‘চাইল্ড এন্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ (Child & Old Age Care.) নামের ফেসবুক পেজ থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। ২০২১ সালের ৩০ এপ্রিল থেকে ১ এপ্রিল, ১ এপ্রিল থেকে ২ এপ্রিল ও ৭ মে থেকে ৯ মে মোট তিনবার বিজ্ঞাপন চালাতে খরচ করা হয় ৩০০ ডলার। ওই বিজ্ঞাপনে মোদী ও ইমরান খানের ছবি দিয়ে লেখা হয়, “ভোট চলছে! মুসলিম বিশ্বের নেতা ইমরান খানতে জিতাতে লাইক বাটনে ক্লিক করে সঙ্গে থাকুন।”


এদিকে মিল্টন সমাদ্দারের বৃদ্ধাশ্রমের মাধ্যমে দাফন হওয়া মরদেহের সংখ্যার হিসাব মিলছে না। তার দাবি করা ৯০০ মরদেহের মধ্যে ৮৩৫টি মরদেহের দাফনের কোনো তথ্য নেই। মিল্টন সমাদ্দারের ফেসবুক পেজ ঘেঁটে দেখা যায়, তার আশ্রমে সব সময় আড়াইশ থেকে তিনশ অসুস্থ রোগী থাকেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে রাস্তায় যারা মারা যান, তাদের দাফন করেন মিল্টন। আবার তার আশ্রমে অবস্থানকালেও অনেকে মারা যান। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় ৯০০ মরদেহ দাফন করেছেন বলে মিল্টন দাবি করেন।

মিল্টন জানান, যাদের দাফন করা হয়েছে তাদের মধ্যে ৬০০ জন তার আশ্রমে মারা গেছেন। আর বাকি ৩০০ মরদেহ রাস্তা থেকে এনে তিনি দাফন করেছেন। এসব মরদেহ রাজধানীর মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থান, রায়ের বাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থান ও আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে বলে দাবি তার।

তবে অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। সরেজমিন মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে গিয়ে জানা যায়, মিল্টন সমাদ্দারের প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে সেখানে সব মিলিয়ে ৫০টি মরদেহ দাফন করা হয়েছে। এসব মরদেহের ডেথ সার্টিফিকেট কালবেলার হাতে রয়েছে।

এ ছাড়া রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে ১৫টির মতো মরদেহ দাফনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে আজিমপুর কবরস্থানে ওই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত কোনো মরদেহের দাফন হয়নি বলে নিশ্চিত করেছেন সেখানকার দায়িত্বরতরা। তাহলে মিল্টন সমাদ্দারের দাবি অনুযায়ী ৯০০ মরদেহ দাফন করা হলে বাকি ৮৩৫টি মরদেহ কোথায় গেছে?

অন্যদিকে চাইল্ড এন্ড ওল্ড এজ কেয়ারে থাকা বৃদ্ধদের অস্বাভাবিক মৃত্যু এবং তাদের কিডনি কেটে বিক্রি করারও অভিযোগ রয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মিল্টন সমাদ্দারের দক্ষিণ পাইকপাড়া আশ্রমের কাছেই বায়তুর সালাম জামে মসজিদ। এই মসজিদে এক সময় তার প্রতিষ্ঠানে নিয়ে আসা মরদেহ বিনামূল্যে গোসল করানো হতো। তার মানবিক কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে মসজিদ কর্তৃপক্ষ তাকে এই সুবিধা দিয়েছিল। তবে গোসল করানোর সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা প্রায় প্রতিটি মরদেহের বিভিন্ন স্থানে কাটাছেঁড়ার দাগ শনাক্ত করেন। করোনার সময় এ বিষয়ে মিল্টন সমাদ্দারকে প্রশ্ন করে মসজিদ কর্তৃপক্ষ। এরপর তিনি ওই মসজিদে মরদেহ পাঠানো বন্ধ করে দেন।

মিল্টন সমাদ্দারকে দীর্ঘদিন ধরে চেনেন স্থানীয় একটি মাদ্রাসার পরিচালক তোফাজ্জল হোসেন। তিনি বলেন, ‘মিল্টন এক সময় বাসা ভাড়া শোধ করতে পারতেন না। এখন তিনি এগুলো করে কোটি কোটি টাকার মালিক। দামি গাড়িতে চড়েন। আড়ালে মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চুরি করেন। আমাদের বায়তুর সালাম মসজিদে ওর মরদেহ ফ্রি গোসল করিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিছু মরদেহ গোসল করানোর পর দেখা যায়, সবগুলোর শরীরে কাটা দাগ। এ বিষয়ে মিল্টনকে প্রশ্ন করা হলে তিনি মরদেহ পাঠানো বন্ধ করে দেন।’

একটি আশ্রমে এত মানুষের মৃত্যুর বিষয়টি অবহিত করে মন্তব্য চাওয়া হলে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহাবুব বলেন, ‘এত মানুষ মারা যাওয়া অস্বাভাবিক। তার মানে উনার এখানে প্রোপার চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। তা ছাড়া উনি কতজনকে হাসপাতালে রেফার করেছেন, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে। উনার এখানে তো সবাই মারা যেতে পারে না। কেউ বেশি অসুস্থ হলে তাকে হাসপাতালে পাঠাতে হবে, চিকিৎসা করাতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘আশ্রম হসপিটালাইজড হলে সেখানে স্পেশালাইজড চিকিৎসক কে আছেন, সেটা দেখতে হবে। থাকলেও তিনি নিয়মিত যান কি না, সেটাও দেখতে হবে। প্রোপার চিকিৎসা হলে এত মানুষ মারা যাওয়ার কথা নয়।’

সার্বিক বিষয় নিয়ে পক্ষ থেকে গতকাল (২৪ এপ্রিল) মিল্টন সমাদ্দারকে ফোন করে মরদেহ দাফনের হিসাবে গরমিল সম্পর্কে একাধিকবার প্রশ্ন করা হলেও তিনি কোনো সদুত্তর দেননি। অন্যান্য বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘আমি চিনি না। আপনি সাংবাদিক কি না, সেটা আমি কীভাবে বুঝব?’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করেন। আমার কোনো সমস্যা নাই, সারা দেশের মানুষ জানুক। তবে সেটা প্রোপার ইনভেস্টিগেশন করে করেন।’

সূত্র : কালবেলা

প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে।