প্রচ্ছদ সারাদেশ জাহাজে সাত খুন: আসামি আকাশ কেন ইরফান, বেরিয়ে এলো চাঞ্চল্যকর তথ্য

জাহাজে সাত খুন: আসামি আকাশ কেন ইরফান, বেরিয়ে এলো চাঞ্চল্যকর তথ্য

চাঁদপুরের মেঘনা নদীতে জাহাজে সাত খুনের ঘটনায় মামলা হওয়ার পর এবং আহত জুয়েলের দেয়া তথ্যে বেরিয়ে আসে আকাশ মণ্ডল ইরফানের নাম। ঘটনাটি ডাকাতি বলে প্রচার হলেও ঘটনার দৃশ্যপট দেখে ভিন্ন কিছু সন্দেহ হয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর। আর ইরফান নামে ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার পর ঘটনার মোড় ঘুরে অন্য দিকে। নাম গোপন রেখে জাহাজে চাকরি নেয়ার কারণ নৌপুলিশকে জানিয়েছেন ২৬ বছর বয়স্ক ইরফান। এর মধ্যে তদন্তে তার এলাকার জীবনের পেছনের নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড উঠে এসেছে। শুক্রবার (২৭ ডিসেম্বর) এ তথ্য জানিয়েছেন চাঁদপুর নৌপুলিশ সুপার কার্যালয়ের উপ-পরিদর্শক শেখ আব্দুস সবুর।

তিনি বলেন, রিমান্ডে ইরফান জানিয়েছেন তিনি ভৈরবে নৌযানে কর্মরত অবস্থায় কলেমা পড়ে মুসলিম ধর্মে ধর্মান্তরিত হন। মূলত তার পেছনের জীবনের ছোটখাটো অপরাধমূলক কাজকে আড়ালে রেখে ভালো ছেলে হিসেবে নিজেকে মেলে ধরতেই ইরফান নাম দিয়ে জাহাজে খালাসি পদে চাকরি নেন। তবে তার আইডি কার্ডে এখনো আকাশ মণ্ডল নামটিই রয়েছে।

কুমিল্লার র‌্যাব ১১-এর উপ-পরিদর্শক মো. তারেক বলেন, ইরফানকে আমরা বাগেরহাটের চিলমারী থেকে গ্রেপ্তার করি। সেখানেই তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন বেতন-ভাতা, রাগ ও ক্ষোভের থেকে একাই তিনি এই সাতটি খুন করেন। সবাইকে ঘুমের ওষুধ রাতের খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ান। এরপর পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী জাহাজের মাস্টারকে হত্যার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার নৃশংস পরিকল্পনা। পরে ধরা পড়ার ভয়ে একে একে আরও ছয়জনকে তিনি হত্যা করেন। এ সময় জুয়েল নামে আরেকজনকে একই কায়দায় আঘাত করলেও প্রাণে বেঁচে যান তিনি। ঘটনার পর জুয়েলের মাধ্যমেই চাঞ্চল্যকর সাত খুনের রহস্য উন্মোচিত ও খুনি চিহ্নিত হয়েছে।

যদিও কার্গো জাহাজ এমডি আল বাখেরার মালিক মাহবুব মোর্শেদ ডাবলু বলেন, ইরফান নাম দিয়ে আমার জাহাজে সে খালাসির পদে চাকরি নিয়েছিল। তাকে বেতন-ভাতাসহ অন্য সুবিধা দেয়া হতো না- এ অভিযোগ বানোয়াট। আমি সাত খুনের ঘটনায় ৮ থেকে ১০ জনকে অজ্ঞাত দেখিয়ে ইতোমধ্যে হাইমচর থানায় মামলা করেছি।

পুলিশ ও স্থানীয়দের থেকে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে জানা গেছে, ইরফান তার নিজ এলাকা বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার মূলঘর গ্রামেও আকাশ মণ্ডল নামেই পরিচিত। তার বাবা জগদীশ মণ্ডল মারা যাওয়ার পরই তারসহ পুরো পরিবারের অধপতন শুরু হয়। তার মা অভাব-অনটন সহ্য করতে না পেরে তাদের দুই ভাইকে ফেলে ইসলাম ধর্মগ্রহণ করে মুসলিম যুবকের সঙ্গে বিয়ে করে চলে যান। পরে নানা-নানির কাছে তিনি থাকা শুরু করার একপর্যায়ে কিছু দিনের ব্যবধানে তারাও মারা যান। এরপর তার একমাত্র আপন বড়ভাই বিধান মণ্ডলও মুসলিম মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে ইসলাম ধর্মগ্রহণ করে আবির হোসেন নাম নিয়ে সেও আলাদা থাকতে শুরু করেন।

ইরফানদের প্রতিবেশী জিহাদুল ইসলাম ও মো. জুয়েল বলেন, আকাশ নামের ছেলেটি ২০১৮ সালের দিকে একটি মুসলিম মেয়ের সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে এলাকা ছাড়া হয়। এরপর ২০২২ সালের দিকে পুনরায় এলাকায় এসে তার ভাইয়ের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হওয়ায় আবার নিরুদ্দেশ হন। এখন ফেসবুকে দেখে জানলাম তিনি জাহাজে সাতজনকে খুন করেছেন। তবে আকাশ অভাবের তাড়নায় এলাকায় মানুষের ক্ষেত, পুকুরে শাক ও মাছ চুরির অপরাধে জড়িয়েছিলেন। তবে কাউকে মারধর করা কিংবা আঘাত করার মতো দুঃসাহস কখনো দেখাননি।

আকাশের বড় ভাই আবির হোসেন বলেন, আমার নানা-নানি থাকতেন সরকারি জায়গায় ঝুপড়ি ঘরে। তাদের মৃত্যুর পর আমিও সেখানেই থাকি। আমাদের পৈতৃক নিবাস মোল্লাহাট উপজেলার কোদালিয়া গ্রামে হলেও ছোটবেলায় বাবার মৃত্যুর পর মা ধর্মান্তরিত হয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ায় আমরা দুই ভাই নানা-নানির কাছেই বেড়ে উঠি। আমি ফলতিতাবাজারে সিলিন্ডার গ্যাস বিক্রির একটা ছোট দোকান দিয়েছিলাম। সেখানে কাজের সময় আকাশ একটি নারীর সঙ্গে প্রেমঘটিত ঘটনায় এলাকা ছাড়ে। এরপর আর ওই দোকান সেখানে বেশি দিন টিকেনি। গত শীতে একদিনের জন্য সে বাড়িতে আসলে তাকে বকাঝকা করে তাড়িয়ে দেই। এরপর থেকেই সে জাহাজে জাহাজে কাজ করে। আমার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ ছিল না। তবে এলাকায় থাকাকালীন সে বিয়ে করেনি এবং মাছ ধরা ও দিনমজুরি কাজ করত।

এদিকে চিকিৎসাধীন জুয়েল নৌ-পুলিশকে জানিয়েছেন, এই ছেলেই ছিল সেই ঘাতক এবং সেই ছিল জাহাজের নিখোঁজ নবম ব্যক্তি।

বিষয়টি নিশ্চিত করে জেলা প্রশাসকের চার সদস্যের তদন্ত কমিটির সদস্য চাঁদপুর নৌ-পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, গলায় অসুস্থতায় কথা বলতে না পারলেও কাগজে ৯ জনের নাম লিখেছিলেন জুয়েল। সেখানে হতাহতের আটজন বাদে অন্য নামটি মূলত ইরফানই ছিল। তিনি জুয়েলের গলায় জখম চালিয়েছে।

তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, জাহাজটিতে কোনো সিসি ক্যামেরা ছিল না। সবাই ঘুমন্ত ছিলেন এবং ওই দিন সবাই রুমের দরজা খোলা রেখেছিল। দরজা ভাঙা না থাকায় বিষয়টি সহজভাবে বুঝা গেছে এবং জুয়েলের কাছ থেকে এটি নিশ্চিত হয়েছি। তবে জুয়েল ভেতর থেকে দরজা লক করায় মূলত প্রাণে বেঁচে ছিলেন। দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার কাজ এগিয়ে নিচ্ছি আমরা।

২৫০ শয্যাবিশিষ্ট চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালের আরএমও ডা. আসিবুল ইসলাম আসিব বলেন, জাহাজে সাত খুনের প্রত্যেকটা মরদেহের ময়নাতদন্ত আমি করেছি। প্রত্যেকেরই কানের একটু ওপরে মাথায় কোপ দিয়ে মারা হয়েছে। যে একজনকে ধরা হয়েছে, সে নেশাগ্রস্ত ছিল কিনা সন্দেহ। তার উগ্র আচরণের বহিঃপ্রকাশেই এমন কাণ্ড হতে পারে।

প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে।