
বয়স হয়েছে। উঠে দাঁড়াতে পারছে না। চলতে-ফিরতে কষ্ট। মেজাজ তিরিক্ষি। ভালো কথা মুখে আসছে না। সার্বক্ষণিক মৃত্যুভয়, তবুও হুংকার কমে না। একসময়ের কাছের বন্ধুরাও দূরে দূরে। মধু নেই, তাই মৌমাছিরা ঘুরঘুর করে না। প্রতিবেশীর করুণায় এখন কুহুকিনী আশায় দিন কাটছে, কখন আবার উঠে দাঁড়াতে পারবে। ভূমিকা না বাড়িয়ে বলা যায়, এটা হচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বর্তমান অবস্থা। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এ দলটি বারবার উপরে উঠেও অতল গহ্বরে তলিয়ে যায়। ১৯৭৫-এর পতনের পর ক্ষমতায় আসতে একুশ বছর লেগেছে। ২০২৪-এর পর উঠে আসতে পারবে কি?
আওয়ামী লীগ যে পন্থায় ফিরতে চায়, তাও কি সম্ভব? প্রথমত, নির্বাচন ব্যতিরেকে; দ্বিতীয়ত, সন্ত্রাসী কার্যক্রমের মাধ্যমে; তৃতীয়ত, ভারতীয় সহায়তায়। যেগুলো একান্তই বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ। আরও গভীরে গেলে বলা যায়, আওয়ামী লীগ যতবার ক্ষমতায় এসেছে, প্রতিবারই অস্বাভাবিক পন্থার সুযোগ নিতে হয়েছে। ১৯৭০-এর নির্বাচন ছিল ১৯৬৯-এর গণ-আন্দোলন ও পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যপ্রভাবিত। ’৭০-এর নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতার আধিক্যে মুক্তিযুদ্ধকালীন আওয়ামী লীগের অস্থায়ী সরকারকেই ভারত সব সাহায্য-সহযোগিতা করে। দেশের প্রথম সংবিধান পাশ হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ চরম রিগিং ও অনিয়মের সুযোগে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে একক সরকার গঠন করে। বিরোধী দলবিহীন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রা গলদেই শুরু হয়। আওয়ামী লীগের অরাজনৈতিক কার্যকলাপ, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও সীমাহীন দুর্নীতির কারণে জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায় নেমে এলে শেখ মুজিব সব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে একদলীয় শাসন বাকশাল কায়েম করেন। জনগণের ওপর এ ব্যবস্থা জগদ্দল পাথরের মতো চাপিয়ে দেওয়া হয়।
১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান তার ব্যর্থতার খেসারত দেন। আওয়ামী লীগের কিছু নেতা ও বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হন। আওয়ামী লীগ নেতারাই মন্ত্রিসভা গঠন করেন, যা তিন মাসের বেশি স্থায়ী হয়নি। সামরিক অভ্যুত্থান ও পালটা অভ্যুত্থানের পর সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান পরবর্তীকালে গণতন্ত্রের দরজা খুলে দেন। বহুদলীয় গণতন্ত্রে আওয়ামী লীগসহ স্বাধীনতাবিরোধী দলও নিবন্ধিত হয়।
১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকার কারণে পারিবারিক হত্যাযজ্ঞ থেকে রক্ষা পান। তারা দীর্ঘদিন ভারতে নির্বাসিত থাকার পর ১৯৮১ সালে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তার আগমনের ১৩ দিনের মাথায় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সেনাবিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন। দেশে ফিরে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের হাল ধরেন ও কোনো না কোনোভাবে রাজনীতির মাঠে টিকে থাকার পদক্ষেপ নেন।
পরবর্তীকালে এরশাদবিরোধী আন্দোলন জোরদার হলে বিএনপি, জামায়াত ও আওয়ামী লীগ ত্রিদলীয় জোট সৃষ্টি করে এরশাদ সরকারকে হটিয়ে দেয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের ভাগ্য ফেরে না। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন পরিচালনা করে। বিএনপি নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ প্রতিহিংসাবশত নির্বাচনে জয়ী বিএনপিকে গণতান্ত্রিক সরকার পরিচালনায় সহযোগিতা না করে দেশে লাগাতার হরতাল, আমলাদের জনতার মঞ্চ ইত্যাদির মাধ্যমে এক অরাজকতা সৃষ্টি করে। এর মাঝে জেনারেল নাসিমের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান আরেক মাত্রা যোগ করে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জন্য বিএনপি নির্বাচন ঘোষণা করলে সব রাজনৈতিক দল প্রত্যাখ্যান করে। একতরফা নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটাতে কেয়ারটেকার বিল পাশ করে সংসদের বিলুপ্তি ঘটায়। নতুন কেয়ারটেকার পদ্ধতি অনুযায়ী বিচারপতি হাবিবুর রহমানের সরকারের অধীনে নির্বাচন হলো। শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের আগের ভুলভ্রান্তির জন্য ক্ষমা চেয়ে একটিবারের জন্য ভোট ভিক্ষা চাইলেন। আওয়ামী লীগ ভোটে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে।
২০০১ সালে আবারও নির্বাচন এলো। শেখ হাসিনা নির্বাচন সামনে রেখে সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনকে তার অনুকূলে সাজিয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দেন। কিন্তু বিধিবাম। পরবর্তী কেয়ারটেকার সরকারের দায়িত্ব নিয়ে বিচারপতি লতিফ প্রথম রাতেই বেসামরিক প্রশাসন ওলটপালট করে দিলে শেখ হাসিনার কাঙ্ক্ষিত পন্থায় নির্বাচন হলো না। তাকে বিরোধী দলেই বসতে হলো।
বিএনপি সরকার গঠন করলেও সরকারি ও বিরোধী দলের অসহযোগিতা দেশের রাজনীতি অশান্ত করে তোলে। এ সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রান্তে সরকারি দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ একে অপরের প্রতি মারমুখী অবস্থানে চলে যায়। আওয়ামী লীগ সর্বত্র সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে জনজীবন অশান্ত করে তোলে। তারা লগি-বৈঠার সমাবেশ করে প্রকাশ্যে লোকজনকে পিটিয়ে হত্যা করে। সমঝোতার পথ খোলা না থাকায় সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দিনের অস্থায়ী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদ এতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এর মাঝে নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটে। দীর্ঘ আড়াই বছর পর নতুন নির্বাচন দেওয়া হলো। জেনারেল মঈন ইউ আহমেদের কারসাজিতে আওয়ামী লীগ সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে। সংসদে গিয়েই শেখ হাসিনা কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচনের পদ্ধতি বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন পদ্ধতি চালু করেন। শুরু হয় গণতন্ত্রের অজ্ঞাত যাত্রা। দলীয় সরকারের অধীনে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে আওয়ামী লীগ ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে ভোটারবিহীন একক নির্বাচন করে। গণতন্ত্রের নামে প্রহসনে সহযোগী হয় জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের জোট। এটা পরিষ্কার যে, আওয়ামী লীগ সবসময়ই কোনো না কোনো গোলমালের পরিস্থিতি সৃষ্টি না করে ক্ষমতায় আসতে পারেনি। ১৯৭৩ থেকে শুরু করে ২০২৪ সাল পর্যন্ত যেসব নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে, সেই নির্বাচনের আগের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়।
আওয়ামী লীগের দুর্বলতা হলো একক কর্তৃত্ব ও স্বেচ্ছাচারী নেতৃত্ব। পারিবারিক আধিপত্যকে গুরুত্ব দেওয়া এ দলটিতে গণতন্ত্রের চর্চা ছিল না। রাষ্ট্রীয় নীতিমালা বা সরকার পরিচালনার কোনো বিষয় দলীয় ফোরামে কখনো আলোচিত হয়নি। দল যখনই ক্ষমতায় এসেছে, তখনই ঘাপটি মেরে বসে থাকা সুবিধাভোগীরা রাতারাতি মুজিব কোট পরে ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে হামলে পড়েছে অর্থ-সম্পদ লুটের মচ্ছবে। অতি দ্রুতই তারা সটকে পড়েছে পার্টির দুর্দিনে। দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা আত্মীয়স্বজন ও নেতাকর্মীদের দুর্বৃত্তায়নের সুযোগ করে দেন।
শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ছিল নীতির চেয়ে আবেগনির্ভর। তাকে চ্যালেঞ্জ করার কেউ ছিল না বলেই তার মাঝে স্বেচ্ছাচারিতা জন্ম নেয়। দলের রাজনৈতিক চর্চা ব্যক্তির ইগোর কাছে হেরে যায়। আদর্শের চেয়ে অর্থবিত্তের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। এতকিছুর পরও শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দেশে ফেরত আসার পর পনেরো বছর লেগেছে ক্ষমতায় যেতে। রাজনৈতিক উত্তরাধিকার শেখ পরিবারের কাছে থাকলেও পরবর্তী উত্তরাধিকারী কে/কারা হবে, সেভাবে নেতৃত্বের স্তর সৃষ্টি হয়নি। ফলে এখনো সবাই শেখ হাসিনার দিকেই তাকিয়ে আছে। শেখ হাসিনার অবর্তমানে এ দল আবারও ভেঙে টুকরো হবে এটা নিশ্চিত। কারণ শেখ পরিবারের সবাই দুর্নীতিগ্রস্ত, যাদের দ্বারা রাজনীতিতে ফিরে দলের ঐক্য প্রতিষ্ঠা অসম্ভব।
আওয়ামী লীগের এখন যা করার, তা না করে গতানুগতিক রাজনীতির ধারায় চলছে। সত্যিটা মেনে নিয়ে দলকে নতুন উদ্যমে পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা বাঞ্ছনীয়। তা না করে ভাব দেখানো হচ্ছে শেখ হাসিনা এখনো প্রধানমন্ত্রী! প্রশাসনের সবাই তার জন্য কাজ করবে ও তিনি একদিন আনুষ্ঠানিকভাবে গদিতে বসবেন! শেখ হাসিনা যদি দূরদর্শী হতেন, তাহলে তার সরকারের ব্যর্থতার নেপথ্যে যারা ছিলেন, তাদের চিহ্নিত করে নতুন নির্দেশনা দিতেন। যুদ্ধে জিততে হলে মাঠে আসতে হবে। ভারতে বসে যুদ্ধ হবে না। নিজের হাঁটুর জোর না থাকলে অন্যের জোরে কাজ হবে না।
ভারতে বসে আওয়ামী লীগের ছোট-বড় নেতা এবং শেখ হাসিনা যে হুংকার দিচ্ছেন, সেটা কার্যকর করবে কে? নেতারা পলাতক। দেশে এসে জেল-জরিমানা ও আইনি বেড়াজালে জড়াতে হবে বলেই আসছেন না। পাচার করা যা অর্থবিত্ত আছে, সেটা খোয়াতে চান না। শেখ পরিবারের কেউ কষ্ট স্বীকার করবে না, আগেও করেনি। অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে গরিব কিছু কর্মীকে দিয়ে ইনসারজেন্সি শুরু করলেও কোনো ফল হবে না। ইনসারজেন্সি একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া, যা আওয়ামী লীগকে কয়েক বছরেও ক্ষমতায় আনতে পারবে না। তাহলে আওয়ামী লীগের শেষ অবস্থান কি বৃদ্ধাশ্রমে?
সূত্র: যুগান্তর