প্রচ্ছদ জাতীয় অবশেষে বাজল নির্বাচনের ঘণ্টা, কাটল ধোঁয়াশা

অবশেষে বাজল নির্বাচনের ঘণ্টা, কাটল ধোঁয়াশা

জাতীয়: নির্বাচন কবে হবে- সেই প্রশ্নে অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কথা চালাচালির অবসান ঘটালেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নিজেই; জানিয়ে দিলেন জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ।

ভোটার তালিকা প্রস্তুত করা ও সংস্কার চিন্তা বিবেচনায় নিয়ে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে আরও ছয় মাস হাতে নিয়ে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধে নির্ধারণের কথা বলেছেন তিনি।

দেশের ৫৪তম বিজয় দিবস সোমবার সকাল ১০টায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়নের কথা বর্ণনার পাশাপাশি নির্বাচনের রূপরেখা তুলে ধরেন।

তিনি বলেছেন, “যদি অল্প কিছু সংস্কার করে ভোটার তালিকা নির্ভুলভাবে তৈরি করার ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হয়, তাহলে ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়তো সম্ভব হবে। ” “আর যদি এর সঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করি তাহলে আরও অন্তত ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে। মোটাদাগে বলা যায়, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়।”

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়, কয়েক ধাপে যার সদস্য সংখ্যাও বাড়ানো হয়। তবে অন্তর্বর্তী সরকারকে শুরু থেকেই একটি নির্বাচনি রোডম্যাপ দেওয়ার চাপে রেখেছিল দেশের বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি।

নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার আহ্বান রেখে বিএনপি নেতারা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। তবে বিষয়টি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার খোলামেলা কথা বলছিল না। অবশ্য তাদের ভাষ্য ছিল- আগে সংস্কার, পরে নির্বাচন। প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দেওয়ার কথা বলছিলেন উপদেষ্টারা।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস এর আগে যতবার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন, সেগুলোতে তিনি নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে কোনো কথা বলেননি। আর প্রতিবারই বিএনপির মহাসচিবসহ শীর্ষ নেতারা কাঙ্ক্ষিত ঘোষণা না আসায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

প্রধান উপদেষ্টার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার আগের দিন রবিবার ঢাকায় মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বিএনপির এক আলোচনা সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সেখানে বক্তব্য দেওয়ার সময় রাষ্ট্র মেরামতে কত দিন সময় লাগবে, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সেটি তিনি জানতে চান।

তিনি বলেন, “নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার কথা শুনলে উপদেষ্টাদের চেহারায় অস্বস্তির ছাপ ফুটে ওঠে, যা জনআকাঙ্ক্ষা-বিরোধী। সরকার তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে জনগণের কাছে যত বেশি স্বচ্ছ থাকবে, জনগণ তত বেশি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে।”

নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বচ্ছতা আসবে বলে মনে করেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, “বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কী করতে চাইছে, রাষ্ট্র মেরামত করতে আর কত মাস কত সময় লাগবে; সেটি জানার অধিকার জনগণের রয়েছে। সরকার রোডম্যাপ ঘোষণা করলে জনগণের কাছে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করবে। প্রশাসনিক কার্যক্রমে গতিশীলতা আসবে।”

তারেক রহমানের এই মন্তব্যের আগের দিন ১৩ ডিসেম্বর ঢাকার গুলশান সোসাইটির এক অনুষ্ঠানে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান নির্বাচিত সরকারের অধীনে রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি তোলায় রাজনৈতিক দলগুলোর অতীতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

তিনি বলেছিলেন, “আজকে তারা বলছে, সংস্কার তারাই সবচেয়ে ভালো করতে পারবে, এটাই তো গণতান্ত্রিক দেশের কথা। তাইলে তারা ৫৩ বছর কেন করেন নাই?”

গুলশান সোসাইটি জামে মসজিদের সামনে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সচেতনতামূলক এক কর্মসূচিতে গিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে রিজওয়ানা বলেন, “কেন আজকে আমাদের দায়িত্ব নেওয়া লাগল, উড ইউ প্লিজ অ্যানসার? তাদেরকে (রাজনৈতিক দল) ছাড়া সমস্যার সমাধান হবে না- এটা সঠিক কথা, এটাই তো হওয়া উচিত।”

তিনি বলেন, “নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সমস্যার সমাধান করবে। তাইলে আজকে বায়ুদূষণ নিয়ে আমাকে কেন প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছে। শব্দ দূষণ নিয়ে গুলশান সোসাইটিকে কেন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হচ্ছে।

“তারা যে সমস্যার সমাধান করে ফেলবে- তারা কি কোনো রূপকল্প আমাদেরকে দিয়েছে? তারা বলছে, রোডম্যাপ দিতে হবে, এই করতে হবে…। তারা কি একটি রোডম্যাপ দিয়েছে যে তারা কীভাবে এ সমস্যার সমাধান করবে?”

কবে নির্বাচন হতে পারে- এমন প্রশ্নে উপদেষ্টা রিজওয়ানা বলেন, “নির্বাচন কতদূর, তা প্রধান উপদেষ্টা নিজেই আপনাদের জানাবেন।”

তিনি বলেন, “একটা নির্বাচনের দিকে যেতেই হবে এই দেশকে- এটাই হচ্ছে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বড় প্রাধান্য; ঠিক তেমনই সংস্কারও বড় একটি প্রাধান্য।”

৭ ডিসেম্বর ঢাকার গুলশানে এক সেমিনারে নির্বাচন নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছিলেন, আগামী বছরই রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত একটি সরকার দেখা যাবে।

তবে তিনি এও বলেছেন, “এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত, জানি না আসলে কী হবে।”

ব্যক্তিগত মতামত বললেও ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের কথারই প্রতিধ্বনি শোনা গেল প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের মুখে। প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের যে রোডম্যাপ দিয়েছেন, সেটি ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যেই নির্ধারণের কথা বলেছেন। অর্থাৎ ওই বছরের জুলাইয়ের আগেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেখতে পারে দেশ।

এর আগে সেনাপ্রধানও একবার নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ নিয়ে কথা বলেছিলেন। ২৩ সেপ্টেম্বর ঢাকায় জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান তার কার্যালয়ে বসে রয়টার্সকে দেওয়া এক বিরল সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “যাতে আগামী ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে সে জন্য তিনি যেকোনো পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন দেবেন।”

সেনাপ্রধানের কথাকে তার ব্যক্তিগত মতামত বলে মন্তব্য করেছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেছিলেন, নির্বাচনের সময় নির্ভর করবে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ও তা নিয়ে রাজনৈতিক আলোচনার ওপরে। তারপর সময়ের বিষয় আসবে- নির্বাচন কবে হবে।

শফিকুল আলম বলেছিলেন, “এটা (নির্বাচন) কবে হবে? ১৬ মাস পর নাকি ১২ কিংবা ৮ মাস পরে, সেটা এখনই নির্ধারিত করা যাচ্ছে না। আর আমার মনে হয় যে, সেনাপ্রধান এখানে ওপিনিয়ন দিয়েছিলেন।”

নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে সরকার ও সেনাপ্রধানের বক্তব্যে মতবিরোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটলো কি না, এমন প্রশ্নে শফিকুল আলম বিবিসিকে বলেছিলেন, “এখানে মতবিরোধের কোনো বিষয় নেই। সেনাবাহিনী সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান এবং সেনাপ্রধান তার ব্যক্তিগত মত দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা সবসময় বলে আসছেন নির্বাচন কখন হবে- এটা জনগণ ঠিক করবে।”

তবে প্রধান উপদেষ্টা প্রেসি উইং থেকে নির্বাচন প্রশ্নে বারবার বলা হয়েছে, নির্বাচনের তারিখ প্রধান উপদেষ্টাই ঘোষণা করবেন।

২৪ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের প্রেস ব্রিফিংয়ে বলা হয়েছিল, প্রধান উপদেষ্টাই সুবিধামতো সময়ে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবেন। প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেসসচিব অপূর্ব জাহাঙ্গীর বলেন, প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে এখনও নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়নি। নির্বাচনের তারিখ প্রধান উপদেষ্টাই ঘোষণা করবেন।

২৭ নভেম্বর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর চলমান ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষাপটে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে প্রয়োজনীয সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ দেওয়ার কথা বলেন।

এর প্রায় দুই মাস আগে ২৮ আগস্ট মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছিলেন, কয়েকজন ব্যক্তির সংস্কারের বিশ্বাস নেই। তখন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ততা না দেখানোর পক্ষে অবস্থান নেন। এ নিয়ে বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের মধ্যে কথা ছোড়াছুড়িও হয়।

তবে একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অবাধ নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতির কথা শুরু থেকেই বলে আসছে অন্তর্বর্তী সরকার। নির্বাচন সংস্কার কমিশন গঠন ও নির্বাচন কমিশন গঠন সেই প্রতিশ্রুতির দুটি বাস্তবতা। নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটি গঠনের ঘোষণার দিন আইন ‍উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছিলেন, নির্বাচনি ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে।

তবে কোনো ঘোষণাতেই ধোঁয়াশা যেন কাটছিল না। সব কথার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করে দিলেন প্রধান উপদেষ্টা। বলা যায়, নির্বাচনি ট্রেন এখন ছুটছে।

প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে।