দেশজুড়ে :বহুল আলোচিত রাজধানীর গুলশানের অভিজাত ফ্ল্যাটে কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়ার (২১) মৃত্যু রহস্য নিয়ে জনমনে এখনো নানা গুঞ্জন চলছে। বীর মুক্তিযোদ্ধার কন্যা মুনিয়া ৩ থেকে ৪ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা (গর্ভবতী) ছিলেন বলে এরই মধ্যে ফরেনসিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তবে অভিযোগ উঠেছে, অদৃশ্য কারণে শিক্ষার্থী মুনিয়া হত্যার প্রকৃত রহস্য ধামাচাপা দেওয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে মামলার অভিযুক্ত প্রধান আসামি বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরসহ প্রভাবশালী একটি মহল।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে সুবিধাভোগী মামলার প্রধান আসামি অভিযুক্ত বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীরের সঙ্গে গভীর সখ্যতা থাকায় ন্যায় বিচার পাননি ভুক্তভোগীর পরিবার। মুনিয়া হত্যায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে এখনো আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি সমাজের সচেতন মহলের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন নিহতের বড় বোন নুশরাত জাহান।
তিনি বলেন, দেশে সংবিধান রয়েছে, আইনের শাসন রয়েছে। কিন্তু অভিযুক্তরা এতই প্রভাবশালী যে, তারা তদন্ত সংস্থা থেকে শুরু করে আদালত অঙ্গনেও অনৈতিক সুবিধা দিয়ে কালো থাবা মেরেছে। অভিযুক্তরা সবাইকে কিনতে পারলেও একজন মেয়ে নুশরাতকে কিনতে পারেনি। তারা নানা কৌশলে হত্যার রহস্যটি ভিন্নখাতে প্রবাহের চেষ্টা চালাচ্ছে। স্পর্শকাতর এ মামলাটি পুনঃতদন্ত ও ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে কলেজ শিক্ষার্থী মুনিয়া হত্যার কলেজ শিক্ষার্থী মোসারাত জাহান মুনিয়াকে বিয়ের প্রলোভনে দিনের পর দিন শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর ফাইল ছবি বিচার চেয়েছেন তার বোন নুশরাত জাহান। একই সঙ্গে নতুনরূপে স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিবেকবান সমন্বয়কদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তে দোষীদের বিচার নিশ্চিতে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন নুশরাতজাহান।
এর আগে গত ১৩ আগস্ট বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সের সামনে জাস্টিজ ফর মুনিয়া ব্যানারে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে ছাত্র-জনতা। গতকাল সোমবার নিহতের পরিবারসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মুনিয়াদের বাসা কুমিল্লা শহরে। তার বাবা শফিকুর রহমান ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মা ছিলেন সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার। মা-বাবা দুজনেই কয়েক বছর আগে ইন্তেকাল করেছেন। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে মুনিয়া ছিল ছোট। মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন মোসারাত জাহান মুনিয়া। এক বন্ধুর মাধ্যমে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীরের সঙ্গে মোসারাত জাহান মুনিয়ার পরিচয় হয়। সেই সূত্র ধরে তাদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়। এরপর ২০১৯ সালে মুনিয়াকে স্ত্রী পরিচয় দিয়ে গুলশানের একটি অভিজাত ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন সায়েম সোবহান আনভীর।
২০২১ সালের ২৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় গুলশানের ১২০ নম্বর সড়কের ১৯ নম্বর বাসার তৃতীয় তলার একটি অভিজাত ফ্ল্যাট থেকে মুনিয়ার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। প্রতি মাসে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা ভাড়ার বিনিময়ে আনভীর মুনিয়াকে ওই ফ্ল্যাটে রেখেছিলেন। এ ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পর সারা দেশে তোলপাড় শুরু হয়। পরকীয়া ও হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে আনভীরকে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে। পরবর্তী সময়ে মুনিয়াকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগ এনে সায়েম সোবহান আনভীরসহ বেশ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন মুনিয়ার বড় বোন নুশরাত জাহান। নিহতের স্বজনরা জানিয়েছেন, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়েই মুনিয়াকে লাখ টাকার ফ্ল্যাটে রেখেছিলেন আনভীর। দীর্ঘদিন ওই তরুণীকে ভোগ করার পর দূরে সরে যেতে টাকা চুরি ও আত্মহত্যার নাটক সাজায় প্রতারক প্রেমিক বসুন্ধরার এমডি সায়েম সোবহান আনভীর। ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত গুলশানের ফ্ল্যাটে একা থাকতেন ওই কলেজছাত্রী।
সেখানে তার প্রেমিক বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সায়েম সোবহান আনভীর যাতায়াত করতেন বলে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। মুনিয়ার বড় বোন ও ভগ্নিপতির অভিযোগ, মুনিয়াকে হত্যা ও অন্তঃসত্ত্বা থাকাসহ পুরো বিষয়গুলো ধামাচাপা দিতে সব ধরনের অপচেষ্টায় লিপ্ত মূল আসামি বসুন্ধরা এমডি সায়েম সোবহান আনভীর। মনে হচ্ছে, তার আর্থিক প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে প্রশাসনও মুখ খুলছে না। গ্রেপ্তার তো দূরের কথা প্রায় দুই মাসেও প্রতারক প্রেমিক আনভীরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি পুলিশ। এক প্রশ্নের জবাবে মুনিয়ার বোন নুসরাত ও মিজান দাবি করেন, মার্চ মাসের শুরু থেকে এপ্রিলের ২৬ তারিখ পর্যন্ত মুনিয়া ফ্ল্যাটে একা থাকাকালে সেখানে নিয়মিত যাতায়াত ও স্বামী-স্ত্রীর মতো বসবাস করতেন প্রেমিক আনভীর। ফলে তার দ্বারা মুনিয়া অন্তঃসত্ত্বা হওয়াটাই স্বাভাবিক। ধারণা করছি, এমন নানা কারণে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করতে রাজি না থাকায় মুনিয়াকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় আনভীর। পরবর্তী সময়ে হত্যার পর আত্মহত্যার নাটক সাজানো হয়। এতে আনভীরের পরিবারের লোকজনও জড়িত। নিহতের পরিবার বলছে, বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে মুনিয়ার পরিবারের সঙ্গে সমঝোতায় যাওয়ার অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন প্রধান আসামি বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীর। মামলা তুলে নিতে বিভিন্নজনের মাধ্যম প্রস্তাব পাঠানোসহ বাদিকে হুমকি-দামকি ও চাপ দেওয়া হয়। এমনকি পদ্মা ব্যাংকের উচ্চ পর্যায়ের লোকজনকে দিয়েওওই ব্যাংকের কর্মকর্তা নুসরাতকে থামানোর চেষ্টা চালানো হয়েছে। এর পাশাপাশি চাপে রাখার কৌশল হিসেবে নানা অপপ্রচার চালানোও অব্যাহত রয়েছে বলে নিহতের স্বজনদের দাবি।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল ও পুলিশের একটি সূত্র জানায়, ২৬ এপ্রিল কলেজছাত্রী মুনিয়ার রহস্যজনক মৃত্যুর পরের দিন প্রকৃত কারণ জানতে ময়নাতদন্তের পাশাপাশি ডিএনএ ও ভিসেরা পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে নমুনা পাঠায় গুলশান থানা পুলিশ। মে মাসের প্রথম দিকে ময়নাতদন্তের প্রাথমিক প্রতিবেদন ও গেল জুন মাসের মধ্যভাগে ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন থানায় পাঠায় ঢামেকের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ। সূত্র জানায়, ওই প্রতিবেদনে কলেজছাত্রী মোসারাত জাহান মুনিয়া মৃত্যুর আগে ৩ থেকে ৪ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়। বিষয়টি ধামাচাপা দিতে জোর লবিং চালায় আসামি পক্ষ। বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি আনভীরের প্রেমিকা মুনিয়ার অন্তঃসত্ত্বা থাকার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও পুলিশ কর্মকর্তারা ইঙ্গিতে বুঝিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন মামলার বাদী নুসরাত জাহান তানিয়া ও তার
স্বামী মিজানুর রহমান সানি। শিক্ষার্থী মুনিয়ার বোন নুশরাত জাহান তানিয়া সবুজ বাংলাকে বলেন, দেশের সংবিধান ও বিচার ব্যবস্থা রয়েছে। সবাই ন্যায় বিচার প্রত্যাশা করে।
তবে সেখানের চেয়ারে থাকা মানুষগুলো কেন যেন এলোমেলো। সেই চেয়ারের মানুষগুলো ঠিক নয়। স্পর্শকাতর এ মামলাটির তদন্ত সংস্থা থেকে আদালত অঙ্গনেও কালো থাবা মেরেছে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি সায়েম সোবহান আনভীর। প্রতিটি সেক্টরেই তার হাত ও লোকবল রয়েছে। কেউ এ ঘটনার ন্যায় বিচার চেয়ে এগিয়ে আসলেও অদৃশ্য কারণে মাঝপথে তা থমকে যায়, যখন টাকা দেয়, বড় অংকের চেক দেয়, তখন তারা চুপ হয়ে যায়। মুনিয়া হত্যায় জড়িতদের সচেতন মহলের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছি। তিনি বলেন, এখনো আমি আমার বোন মুনিয়া হত্যার বিচার চাই, আশা করি আইনি প্রক্রিয়ায়ই এর সমাধান হবে। নুশরাত জাহান বলেন, ক্ষমতার দম্ভ চিরস্থায়ী হয় না, থাকেও না। এর একটি বড় উদাহরণ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। আওয়ামী লীগ সরকারের শাসন- মিলে মুনিয়া হত্যার বিচার পাইনি। দেশের একজন বড় শিল্পপতি সালমান এফ রহমান। আজ দেখুন তার কী পরিণতি। এটার থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। তিনি বলেন, যে বিচার একবার আল্লাহর কাছে চলে যায়, সেখানে আর করার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে এখনো আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি সমাজের কিছুই থাকে না।
এদিকে মামলার বাদী পক্ষের অন্যতম আইনজীবী ব্যারিস্টার এম সারোয়ার হোসেন গণমাধ্যমকে জানান, বিজ্ঞ আদালতের এক আদেশে তারা সংক্ষুব্দ, এ বিষয়ে তারা উচ্চ আদালতে যাবেন, আপিল করবেন।
এদিকে জাস্টিজ ফর মুনিয়া নামে ভেরিফায়েড একটি ফেসবুক পেজে গত ১২ আগস্ট উল্লেখ করা হয়, স্বৈরাচারী সরকারের পতন মাত্র এক সপ্তাহ আগে হলো, চট করে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো ঠিক না। কিন্তু একাধিক সূত্র থেকে পাওয়া একটি বার্তা আমাদের উদ্বিগ্ন করছে। ‘দেশে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে ব্যবসায়ীদের আস্থা পেতে হবে।’ এ বিষয়ে আমরাও একমত। কিন্তু তার মানে কি এই যে “অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা”র অজুহাতে যেই ব্যবসায়ীরা এই স্বৈরাচারী ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখেছিল এবং প্রতিদানে তাদের অপরাধগুলো পার পাইয়ে দেয়া হতো, তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা হবে না? তাহলে দুর্নীতিগ্রস্ত তদন্তকারী এবং বিচারব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হবে কীভাবে? আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা গড়ে উঠবে কীভাবে? এ নিয়ে গত ১৩ আগস্ট বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সের সামনে দাঁড়িয়ে ন্যায় বিচার চেয়ে ‘ঝটিকা প্রতিবাদ’ জানিয়েছেন ছাত্র-জনতা।
সূত্র: সবুজ বাংলা
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |