কী অদ্ভুত বৈপরীত্য দুই দলের ফর্মে! বার্সেলোনা লিগে সর্বশেষ ছয় ম্যাচের ৫টিতেই পয়েন্ট হারিয়েছে – এক জয়ের বিপরীতে হেরেছে ৩টিতে, ড্র অন্য দুটি। অন্যদিকে সব টুর্নামেন্ট মিলিয়ে নিজেদের সর্বশেষ ১১ ম্যাচেই জিতেছে আতলেতিকো মাদ্রিদ।
বাংলাদেশ সময় আজ রাত ২টায় যখন বার্সেলোনার মাঠে নামবে দিয়েগো সিমেওনের আতলেতিকো, প্রশ্ন উঠে গেছে – বার্সা কি এই মুহূর্তে ইউরোপের সবচেয়ে ফর্মে থাকা দলটারই মুখোমুখি হচ্ছে?
অথচ রিওয়াইন্ড করে মাস দুয়েক পেছনে ফিরে যান। ২৭ অক্টোবর যখন রেয়াল বেতিসের মাঠে ১-০ গোলে হারে আতলেতিকো মাদ্রিদ, সেটি লিগে ১১তম ম্যাচে গিয়ে তাদের প্রথম হার ছিল ঠিকই, কিন্তু ততদিনেই লিগের শিরোপাদৌড়ে আর তাদের গোনায় ধরেননি অনেকে।
না ধরারই কথা! বার্সেলোনা তখন উড়ছিল, সেই সপ্তাহেই বার্সার কাছে ৪-০ গোলে হারলেও রেয়াল মাদ্রিদ পয়েন্ট তালিকায় শীর্ষে থাকা বার্সেলোনার পরেই ছিল। আর আতলেতিকো? আগের ১০ ম্যাচের ৫টিতেই ড্র করায় তারা তখন ছিল লিগে ৪ নম্বরে। মাদ্রিদের চেয়ে তখনই ৪ পয়েন্টে পিছিয়ে ছিল তারা, বার্সার চেয়ে ১০ পয়েন্টে!
কিন্তু দুই মাস পর এখন বার্সেলোনা আর রেয়াল মাদ্রিদ – স্প্যানিশ লিগের সবচেয়ে বড় দুই দলের মাথাব্যথা আতলেতিকোই। আজ বার্সার মাঠে নামার আগে তারা পয়েন্ট তালিকার দুই নম্বরে বটে, তবে সেটাতে ‘যদি-কিন্তু’ আছে। শীর্ষে থাকা বার্সার (১৮ ম্যাচে ৩৮ পয়েন্ট) সঙ্গে পয়েন্টে সমান হলেও শুধু গোল ব্যবধানেই পিছিয়ে থাকায় দুই নম্বরে আতলেতিকো, তবে তারা আবার ম্যাচ খেলেছে বার্সার চেয়ে একটি কম। রেয়াল মাদ্রিদ এক পয়েন্ট পিছিয়ে (১৭ ম্যাচে ৩৭ পয়েন্ট) তিন নম্বরে।
এই সপ্তাহের পর যেহেতু স্প্যানিশ লিগে বড়দিন আর নববর্ষের বিরতি পড়ে যাবে, আজ বার্সার মাঠে আতলেতিকো জিতলেই নিশ্চিত হয়ে যাবে, শীর্ষে থেকেই শীতকালীন বিরতিতে যাচ্ছে তারা।
তা আতলেতিকোর এমন উত্থান কীভাবে হলো? যে আতলেতিকোকে দেখে অক্টোবরে মনে হয়েছিল, সিমেওনে বুঝি এই মৌসুমের পর আর থাকছেন না, সেই আতলেতিকোই ১৩ বছর পর লিগ শিরোপার দাবিদার কীভাবে হয়ে উঠল? গত দুই মাসে ফিরে দেখা যাক –
বার্সার হঠাৎ পতন
আতলেতিকো জিতেছে ঠিকই, তবে বার্সাও জিততে থাকলে তো আর পয়েন্ট ব্যবধান কমানো সম্ভব হতো তাদের পক্ষে! সেটা সম্ভব হয়েছে মৌসুমের শুরুতে চোখধাঁধানো ফুটবলে উড়তে থাকা বার্সার হঠাৎ ডানা কেটে যাওয়ায়। মাদ্রিদের মাঠে ৪-০ গোলের জয়ে লিগের প্রথম ১১ ম্যাচেই ১০ জয়ের দেখা পেয়ে যাওয়া হান্সি ফ্লিকের বার্সা ওই ম্যাচের পর লিগে আর জয় পেয়েছে মাত্র একটি! খুব যে বড় দলের কাছে হেরেছে বার্সা, এমনও নয়। সর্বশেষ ছয় ম্যাচের তিনটিতে তাদের হারানো দলগুলোর দুটি লিগের ১৪ আর ১৫ নম্বরে থাকা লাস পালমাস ও লেগানেস।
বার্সা চোটজর্জরিত হয়ে পড়ায়ই হয়তো তাদের এই দশা। আজই যেমন, লামিন ইয়ামালকে ছাড়াই নামতে হবে তাদের। আর লেগানেসের কাছে হারের পর তো দলের আরেকটি সমস্যার কথা পেদ্রিই তুলে ধরেছিলেন, তাঁরা নাকি সেদিন ম্যাচের শুরুটাই করেছিলেন ‘ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে!’
গার্দিওলা হারালেন, পেলেন সিমেওনে
প্রিমিয়ার লিগে ম্যানচেস্টার সিটির হঠাৎ পতনের পেছনে আতলেতিকো মাদ্রিদেরই সাবেক মিডফিল্ডার রদ্রির না থাকা নিয়ে কত কথা হচ্ছে! তবে রক্ষণ আর আক্রমণ কোনো দিকেই গুছিয়ে উঠতে না পারা সিটির এক বড় সমস্যা সম্ভবত হুলিয়ান আলভারেসের না থাকাও।
এই মৌসুমেই সিটি ছেড়ে আতলেতিকোতে যাওয়া আলভারেস শুরুতে ধুঁকলেও এখন দলের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন, তার ছাপ দেখা যাচ্ছে আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকারের ফর্মে – মৌসুমে ১২ গোলের ৮টিই আলভারেস করেছেন সর্বশেষ দুই মাসে, বেতিসের বিপক্ষে ওই হারের পর থেকে। আলভারেসের যখন এমন ফর্ম, সিটিতে হালান্ডের অফ-ফর্মের পরও বিকল্প খুঁজে না পাওয়া গার্দিওলা এখন হয়তো আলভারেসকে ছেড়ে দেওয়া নিয়ে আফসোস করছেন!
গ্রিজমানের মান পড়েনি
মাঝে কিছুদিন ধুঁকেছেন। তাঁর ক্যারিয়ারের শেষদিকে যুক্তরাষ্ট্রের লিগে খেলতে চাওয়ার ইচ্ছার কথা তো সর্বজনবিদিতই, সেক্ষেত্রে এই মৌসুমের শেষেই স্পেন ছেড়ে ৩৩ বছর বয়সী আঁতোয়ান গ্রিজমানের যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার গুঞ্জনের পেছনে বয়সের পাশাপাশি একটা বড় কারণ ছিল তাঁর ফর্ম।
কিন্তু গত সেপ্টেম্বরে ফ্রান্স দল থেকে অবসরে যাওয়া গ্রিজমান যেন এরপর নিজেকে নতুন করে ফিরে পেয়েছেন। সর্বশেষ ছয় ম্যাচেই করেছেন ৭ গোল! এর মধ্যে দুটি এসেছে সেভিয়ার বিপক্ষে ম্যাচের শেষ আধা ঘণ্টায় – শেষেরটি ৯৪ মিনিটে, দুর্দান্ত গোল! ওই দুই গোলে ৩-২ ব্যবধানে পিছিয়ে থাকা আতলেতিকো শেষ পর্যন্ত জিতেছে ৪-২ গোলে। এর পাশপাশি ভায়াদোলিদের বিপক্ষে ৫-০ গোলে জয়ের ম্যাচে যেভাবে চোখধাঁধানো প্রথম স্পর্শে ডিফেন্ডারদের এড়িয়ে গোলটা করেছেন গ্রিজমান, ভায়াদোলিদ সমর্থকেরাও উঠে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছেন!
শুধু তো গোল নয়, গ্রিজমান ছন্দে থাকা মানে আক্রমণ-রক্ষণ আর মাঝমাঠের সঙ্গে আক্রমণের সমন্বয় কোনো কিছু নিয়েই আর চিন্তা করতে হয় না আতলেতিকো কোচকে।
পাল তুলে এগোচ্ছেন দে পল
আর্জেন্টিনায় দে পল মাঝমাঠের ভরসা, কিন্তু আতলেতিকো মাদ্রিদে সেই ২০২১ সালে যোগ দেওয়ার পরও সেভাবে আলো ছড়াতে পারেননি। ৩০ বছর বয়সী মিডফিল্ডার যে বিশ্বের সেরাদের সারিতে কখনো নাম লেখাতে পারেননি, তার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণও ধরা হতো তাঁর ধারাবাহিকতার অভাবকে। এই মৌসুমে সেই দে পলও যেন শেষ পর্যন্ত আতলেতিকোতে পাল তুলে এগোচ্ছেন।
পাবলো বারিওসের সঙ্গে মাঝমাঠে তাঁর সমন্বয়টা হচ্ছে দুর্দান্ত। মাঝমাঠে প্রাণান্ত দৌড়ানো, প্রতিপক্ষের পা থেকে বল কেড়ে নেওয়া হোক আর গ্রিজমান-আলভারেসদের দিকে পাস বাড়ানো – দে পল সবকিছুতেই এখন যেন দুর্দান্ত।
আতলেতিকোর এবারের উত্থানের পেছনে আরেকটি বড় কারণ – তাদের বেঞ্চের খেলোয়াড়েরাও সবাই যেন নিজেদের সুযোগ পেলেই মেলে ধরছেন। রক্ষণে হোসে হিমেনেস আতলেতিকোর বড় ভরসা হলেও তাঁর এতটাই চোটে পড়ার প্রবণতা যে, ক্লাবটিতে ১১ বছরে লিগে এক মৌসুমে সর্বোচ্চ ২৮ ম্যাচ পর্যন্তই খেলতে পেরেছেন। তাঁর চোটে আগের মৌসুমগুলোতে ভুগেছে আতলেতি। কিন্তু এই মৌসুমে দলে আসা রবিন লো নরমান্দ বিকল্প হয়ে দেখা দিয়েছেন, বার্সা থেকে ধারে যাওয়া ক্লেমঁ লংলেও যে এত ভালো খেলবেন, সেটা সম্ভবত কেউই আশা করেননি।
আক্রমণে আলেক্সান্দার সরলথ বা আনহেল কোরেয়ারা প্রয়োজনে নেমেই গোল-অ্যাসিস্টের জোগান দিচ্ছেন, সিমেওনেরই ছেলে জিউলিয়ানো সিমেওনেও কম যাচ্ছেন না! আর মাঝমাঠে চেলসি ছেড়ে আতলেতিকোতে যাওয়া কনর গ্যালাঘারের ফুসফুসের জোর তো স্পেন দেখছেই! রেয়াল মাদ্রিদের সাবেক মিডফিল্ডার মার্কোস ইয়োরেন্তেও ভরসা হয়ে দেখা দিচ্ছেন প্রয়োজনে।
আবেগের কারবার
সিমেওনের দলের একটা দিক তো সবসময়ই আলাদা হয়ে দেখা দেয়, তা হলো, খেলোয়াড়দের সিমেওনের জন্য সবটুকু উজাড় করে দেওয়ার দৃশ্য। সেটা বল পায়ে না থাকলে জমাট রক্ষণের কাজে হোক, কিংবা প্রয়োজনে প্রতিপক্ষের ওপর শরীরের জোর দেখানোতে হোক, বা বল পায়ে পেলে পাসিং ফুটবলে – সিমেওনের শিষ্যরা সিমেওনের ফুটবলকেই ধারণ করেন।
এর কারণ বুঝতে আতলেতিকোর ম্যাচগুলোতে ডাগআউটে তাকালেই হয়। সেখানে যে সিমেওনের আবেগ প্রতিটি ক্ষণে ঝরে পড়তে দেখা যায়। ‘আমরা বনাম তারা’ – জোসে মরিনিওর ঢংয়ে এই মন্ত্রটাই খেলোয়াড়দের কানে ছড়িয়ে দেওয়ায় সিমেওনেও যে অসাধারণ!
এই মৌসুমে আনচেলত্তি যখন রেয়াল মাদ্রিদে ভারসাম্যপূর্ণ একাদশ গড়তেই হিমশিম খাচ্ছেন, ফ্লিকের অধীনে তরুণ বার্সা উড়তে উড়তে হঠাৎই খেই হারিয়ে যখন পথ খুঁজছে, অক্টোবর পর্যন্ত সবার হিসেবের বাইরে থাকাই যেন সুবিধা করে দিয়েছে সিমেওনের। কেউ হিসাবে ধরছে না – এমন মুহূর্তগুলোতেই যে সিমেওনে খেলোয়াড়দের একজোট করে ফেলেন!
সঙ্গে তাঁর ফুটবলমস্তিষ্ক তো আছেই! গার্দিওলা-আর্তেতাদের যুগে সংবাদের শিরোনামে জায়গা না পেলেও ‘আন্ডারডগ’ হয়ে থাকা তাঁর ফুটবল মস্তিষ্কও যে আতলেতিকোর বড় সম্পদ। এমনি এমনিই তো আতলেতি সভাপতি এনরিকে সেরেসো অক্টোবরের শেষদিকে বলেননি, ‘দিয়েগোর চেয়ে ভালো কোনো কোচ আতলেতিকো মাদ্রিদের জন্য আমি কল্পনাও করতে পারি না।
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |