
সারাদেশ: খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের লাশ ঘরে গত ২২ বছরে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার লাশ কেটেছেন সুশীল কুমার ডোম। ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে ময়নাতদন্তের জন্য এসব লাশ কাটেন তিনি। মাঝেমাঝে স্বপ্নের মধ্যেও লাশ কাটতে দেখেন। মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষের লাশ কাটার বিষয়টি মাঝেমধ্যে মানসিক পীড়া দেয় তাকে। তবে রাষ্ট্রীয় কাজে সহযোগিতা করতে পেরে আত্মতৃপ্তিও আছে তার।
সুশীল ডোম আলাপকালে জানান, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ২০০২ সালের এপ্রিল থেকে ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের অধীনে ময়নাতদন্ত কার্যক্রম শুরু হয়। এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১১ হাজার লাশ কেটেছেন তিনি। তিনি বলেন, লাশ কাটার সময় ভয় পাই না, তবে মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি। একদিন স্বপ্ন দেখি যে, মরদেহ সেলাই দিচ্ছি, সেলাই দেয়ার সময় মরদেহ উঠে দৌড় দিয়েছে। তখন তাকে ডেকে বলছি তোমার সেলাই বাকি রয়েছে তাড়াতাড়ি আসো, সেলাই ছাড়া চলে যাচ্ছ কেন? কিছুক্ষণ পর দেখি তার সঙ্গে আরও তিনটি মরদেহ দৌড়ে আমার দিকে আসছে। তখন আমার ঘুম ভেঙে যায়।
সুশীল বলেন, কারও মৃত্যুর পর দুই থেকে তিন দিন গেলে মরদেহ পচে যায়। মাঝেমাঝে সেই পচাগলা, দুর্গন্ধযুক্ত ও পোকায় ধরা মরদেহ কাটতে হয়, সেলাই দিতে হয়। অনেক সময় সেলাই ধরতে চায় না। দুর্গন্ধে কাজ করতে কষ্ট হয়। এছাড়া যখন কোনো ছোট বাচ্চার মরদেহ আসে, তখন সেই মরদেহ কাটতে খুব খারাপ লাগে। কারণ সন্তানতো আমারও আছে। তার মরদেহে ব্লেড চালাতে কষ্ট লাগে, ভাবি যদি আমার বাচ্চা হতো তাহলে কেমন লাগতো! তিনি জানান, মর্গে লাশ কাটার জন্য বেশ কিছু যন্ত্রপাতি আছে, কিন্তু সেগুলো আধুনিক নয়। হাতুড়ি বাটাল দিয়ে মাথার চাড়া কাটতে হয়, ইলেকট্রিক করাত থাকলে কাজ করতে সুবিধা হতো। কিন্তু ইলেকট্রিক করাত না থাকায় কাজ করতে দেরি হয়। সার্জিক্যাল ব্লেড দিয়ে শরীরের অন্যান্য অংশ কাটা হয়।
মাঝেমাঝে কিছু বীভৎস মরদেহ আসে, ট্রেনে কাটা মরদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খণ্ড খণ্ড থাকে। সেগুলো সেলাই করতে অনেক কষ্ট হয়। তারপরও সবসময় চেষ্টা করি মরদেহ কাটার পর সেলাইটা ভালোভাবে দেয়ার জন্য, যাতে তার পরিবারের সদস্যরা ঠিকমতো গোসল করিয়ে জানাজা দিতে পারে। এই পেশাকে পরিবারের সদস্যরা কীভাবে দেখে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার পরিবারের সদস্যরা মেনে নিয়েছে, তারা কেউ কোনো আপত্তি করে না, বা কিছু বলে না। অনেক ডোম মদ খায়, গাঁজা খায়, আমি কখনও এগুলো খাই না। তারা মাদকসেবন ছাড়া কাজ করতে পারে না। খুলনা সদর হাসপাতালে প্রীতম ডোমের কাছ থেকে কাজ শিখেছিলেন তিনি। প্রথমদিকে একটু ভয় লাগলেও এখন আর ভয় লাগে না তার। সুশীল বলেন, তার বড় ছেলে নার্সিং পাশ করে বেরিয়েছে, মেয়ে নার্সিং পরীক্ষা দেবে, আর ছোট ছেলে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। তিনটা সন্তানকে মানুষ করতে চাই। আমি আমার সন্তানদেরকে এ পেশায় আনতে চাই না, কারণ আমি জানি কত কষ্ট করে পচা গলা নোংরা মরদেহ কাটতে হয়। আমি মানুষ হয়ে আরেকজন মৃত মানুষকে কাটছি এটা ভাবলে মাঝেমাঝে খারাপ লাগে। তবে আবার গর্বও হয় যে আমি রাষ্ট্রীয় কাজে সহযোগিতা করছি।