প্রচ্ছদ সারাদেশ যেই সেতু নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন মা, সেখানেই মারা গেল সন্তান

যেই সেতু নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন মা, সেখানেই মারা গেল সন্তান

দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পর গত ১৩ মে উদ্বোধন হয়েছিল দক্ষিণ চট্টগ্রাম জেলার মানুষের স্বপ্নের সেই কালুরঘাট সেতু। এর মধ্য দিয়ে আশা জেগেছিল সেতু ব্যবহারকারী লাখ লাখ মানুষের। বাংলাদেশ সুইডেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সাবেক শিক্ষার্থী জুবাইরা ফেরদাউস ইসরাও এমন খবরে হয়েছিলেন উচ্ছ্বসিত। কিন্তু যেই সেতু নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন মা ইসরা, সেখানেই চোখের পলকে প্রাণ গেছে আড়াই বছর বয়সী মেয়ে সন্তান মেহেরুমা নুর আয়েশার।

বৃহস্পতিবার (৫ জুন) রাত সাড়ে ১০টার দিকে চট্টগ্রামের কালুরঘাট সেতুর বোয়ালখালী অংশে পর্যটক এক্সপ্রেস ট্রেনের ধাক্কায় একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা দুমড়েমুচড়ে যায়। এ ঘটনায় সিএনজিচালিত অটোরিকশায় থাকা শিশু মেহেরুমা নুর আয়েশা, অটোরিকশা চালক মোহাম্মদ তুষারসহ মোট তিনজন মারা গেছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরও তিনজন। হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করছেন স্থানীয়রা।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পর্যটক এক্সপ্রেস ট্রেনটি কক্সবাজার থেকে ছেড়ে এসেছে ৭টা ৪৫ মিনিটের দিকে। ট্রেনটি বোয়ালখালী অংশ থেকে শহরের দিকে ব্রিজ পার হয়ে আসার সময় সিগন্যাল দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সিগন্যাল না মেনেই সেতুর ওপরে উঠে যায় একটি অটোরিকশা। দ্রুত গতিতে আসা ওই ট্রেনের সঙ্গে তখন সংঘর্ষ হয়। সেখানে আরও কয়েকটি মোটরসাইকেলও ট্রেনের নিচে চাপা পড়েছে।

নিহত আয়েশা চট্টগ্রামের বেসরকারি চাকরিজীবী মো. সাজ্জাদুর নূরের মেয়ে। আর সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক মোহাম্মদ তুষার বোয়ালখালী উপজেলার বাংলা পাড়ার মুহাম্মদ আবুল মনসুরের একমাত্র ছেলে। নিহত আরেকজনের পরিচয় এখনো পাওয়া যায়নি।

জানা যায়, ২০২২ সালের ২১ জানুয়ারি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল মো. সাজ্জাদুর নূর ও জুবাইরা ফেরদাউস ইসরা। তাদের ঘর আলোকিত করে পৃথিবীতে আসে মেহেরুমা নুর আয়েশা। সাদা টি-শার্ট ও কালো চশমা পরিয়ে আয়েশার সঙ্গে গত ৪ মার্চ ফেসবুকে এক স্ট্যাটাস দিয়েছিল মা ইসরা। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, তুমিই আমার জীবনের একমাত্র সঙ্গ। এরপর ভালোবাসার দুটি ইমোজি দিয়েছিলেন তিনি।

বৃহস্পতিবার রাতে ফেসবুকজুড়ে ভাইরাল দুর্ঘটনার পরবর্তী একটি ভিডিও। ট্রেনে চাপা পড়ে দুমড়েমুচড়ে যাওয়া সেই অটোরিকশা থেকে এক বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বের হচ্ছে ৩০ বছর বয়সি এক যুবক। তিনি চিৎকার করে বলছেন, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার।

হাসপাতালের করিডরে চিৎকার করতে করতে বাবা সাজ্জাদ বলেন, আমি আল্লাহর কাছে বিচার দিব। আমার ৩০ বছর বয়স, আমি হয়তো দোষ করেছি। কিন্তু আমার বাচ্চার কি দোষ, সে কেন এভাবে মারা গেল।

জিয়াউল আসাদ সিফাত নামে একজন বলেন, জীবনের এক মুহূর্ত বিশ্বাস নাই। আজ আরাফাতের দিনে সবার জন্য নাম ধরে দোয়া করেছিলাম। কিন্তু খবর পেলাম আমার প্রাইমারি স্কুলের বন্ধু জুবাইরা ফেরদৌস ইসরার মেয়ে মেহেরুমা নুর আয়েশা কালুরঘাটের সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। কথা দিয়েছিলাম দেখা হলে ঈদের সালামি দিব, কিন্তু সেটা আর দেওয়া হল না।

সাজ্জাদের বন্ধু ইয়াকুব রাসেল জানান, বাবার কাঁধে কন্যার লাশ৷ পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বোঝা। আল্লাহ জান্নাতের প্রজাপতিটির পরিবারকে শোক সইবার শক্তি দিন৷ ভাবির পায়ের অবস্থা খারাপ। আরাফার দিনের উসিলায় চট্টগ্রামসহ পুরো দেশের মানুষকে আল্লাহ হেফাজত করুন।

বোয়ালখালী সচেতন নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক এম. আবুল ফয়েজ মামুন বলেন, রেল কর্তৃপক্ষ ও সেতু কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে কালুরঘাট সেতু পারাপারে রেল ও গাড়ির যে সংঘর্ষ হয়েছে সেটা খুবই দুঃখজনক। ঈদের আনন্দের আগে এমন দুর্ঘটনা পুরো চট্টগ্রামের মানুষকে শোকাহত করে তুলেছে। এমন অবহেলার জন্য রেল ও সেতু কর্তৃপক্ষের যাদের অবহেলা ছিল তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার দাবি জানাচ্ছি।

তিনি বলেন, বাবার কাঁধে দুই বছরের সন্তানের লাশ আজ চট্টগ্রামের আকাশ-বাতাস অশ্রুসিক্ত হয়েছে। এই অশ্রুসিক্ত নয়নে নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি এবং আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করছি। এমন দুর্ঘটনা যেন ভবিষ্যতে আর না ঘটে সেজন্য অতিদ্রুত কালুরঘাট সেতুর নির্মাণ কাজ দৃশ্যমান এবং শেষ করার দাবি জানাচ্ছি।

চট্টগ্রাম রেলওয়ে পুলিশের ওসি এস এম শহিদুল ইসলাম বলেন, কক্সবাজার থেকে ছেড়ে আসা পর্যটক এক্সপ্রেস ট্রেনের ধাক্কায় কয়েকটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা, টমটমসহ অন্যান্য কয়েকটি গাড়ি দুমড়েমুচড়ে গেছে। ঘটনাস্থলে পুলিশসহ ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছে। এখন পর্যন্ত তিন জন মারা যাওয়ার খবর পেয়েছি। বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের চান্দগাঁও থানার ওসি মো. আফতাব উদ্দিন বলেন, ট্রেনের সঙ্গে কয়েকটি সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ বেশ কয়েকটি গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে এক শিশুসহ তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। কয়েকজনকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। নিহতদের মধ্যে তুষার নামে এক অটোরিকশাচালক রয়েছে। তার বাড়ি বোয়ালখালী উপজেলায়।

সূত্র: কালবেলা