প্রচ্ছদ সারাদেশ ভয়ঙ্কর অপরাধে পুলিশ

ভয়ঙ্কর অপরাধে পুলিশ

সারাদেশ: চট্টগ্রামে পুলিশের কতিপয় সদস্যের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড পেশাদার অপরাধীদেরকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। অর্থের লোভে তারা রীতিমত সংঘবদ্ধ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। গত কয়েক দিনে জিম্মী করে অর্থ লুট, ছিনতাই, পিটিয়ে হত্যাসহ ভয়ঙ্কর সব অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে। অপরাধ দমন যাদের দায়িত্ব তারাই অপরাধীর ভূমিকায় নেমে পড়েছেন। তাতে জনগণের বন্ধু হিসেবে পরিচিত এই বাহিনীর প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতা বাড়ছেই। আবার কিছু অসাধু কর্মকর্তার কারণে পুলিশের অনেক অর্জন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি অথবা বড় অপরাধে ছোট শাস্তি এবং রাজনৈতিক প্রভাবে অপরাধ করেও পার পেয়ে যাওয়ায় পুলিশের কতিপয় সদস্যের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। এক সময় ব্যক্তিগতভাবে অনেকে অপরাধে জড়াতেন। এখন দলবেঁধে অপরাধ করছেন তারা। বড় ধরনের অপরাধে মামলা কিংবা উপর মহলে প্রতিকার চেয়ে আবেদন করার পর ঘটনা জানাজানি হচ্ছে। তবে বেশিরভাগ অপরাধ অজানা থেকে যায়। নীরবে অনেক ভুক্তভোগী জুলুম নির্যাতন হজম করতে বাধ্য হন।

সম্প্রতি মহানগরী ও জেলায় পুলিশ সদস্যদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার কয়েকটি ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে। ভুক্তভোগীরা প্রতিকার চেয়ে আদালতে গেছেন। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার পুলিশের বিরুদ্ধে আরো একটি মামলা হয়েছে। অভিযোগ, অস্ত্র দিয়ে তানভীর হোসেন নামের এক যুবককে ফাঁসানোর চেষ্টা। চট্টগ্রামের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফারদিন মোস্তাকিম তাসিনের আদালতে মামলাটি করেন ভুক্তভোগী যুবকের বড় ভাই রাহাত হোসেন। মামলায় অভিযুক্তরা হলেন- সাতকানিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আতাউল হক চৌধুরী, এসআই আবদুর রহিম, মোস্তাক আহমেদ, এএসআই রেজাউল করিম, ইকবাল হোসেন, জহিরুল ইসলাম, মহিউদ্দিন অনিক ও কনস্টেবল কবির হোসাইন। বাদীর আইনজীবী জোবায়েরুল ইসলাম বলেন, আদালত বাদীর বক্তব্য গ্রহণ করে সাতকানিয়া সার্কেলে সহকারী পুলিশ সুপারকে (এএসপি) তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। মামলার অভিযোগে বলা হয়, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি বাদীর ভাই তানভীর হোসেন চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার ঢেমশা ইউনিয়নের মাইজপাড়া এলাকায় বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলছিলেন। ওই দিন বিকেলে সাদাপোশাকধারী পুলিশ সদস্যরা তাকে ধরে থানায় নিয়ে যায়। পরে খবর নিতে তাদের আরেক ভাই হিরু হোসেন থানায় যান। সেখানে দেখতে পান তার ভাই তানভীরকে থানায় বেধড়ক পেটানো হচ্ছে। কেন পেটানো হচ্ছে, জানতে চাইলে পুলিশ সদস্যরা হিরুকেও থানায় আটকে রাখেন। পরে অবশ্য ছেড়ে দেওয়া হয় তাকে। গ্রেফতারের পর পুলিশ একটি দেশীয় অস্ত্র ও চার রাউন্ড কার্তুজ জব্দ করার কথা জানায় তানভীরের কাছ থেকে। কিন্তু ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, তাকে যখন পুলিশ ধরে নিয়ে যায়, তখন কোনো অস্ত্র ছিল না। তবে সাতকানিয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) আতাউল হক চৌধুরী দাবি করেন মাইজপাড়া বিল থেকে একটি অস্ত্র ও চার রাউন্ড কার্তুজসহ তানভীরকে আটক করা হয়েছে। তখন সেখানে যারা উপস্থিত ছিলেন, তারা সাক্ষী দিয়েছেন। নির্যাতনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আটকের সময় ধস্তাধস্তিতে সামান্য আঘাত পেয়েছেন আসামি। তাকে সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা শেষে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

এর আগে গত বুধবার আইমান রশিদ নামের এক কলেজছাত্রকে অপহরণের পর পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবির অভিযোগে চট্টগ্রাম রেঞ্জ রিজার্ভ পুলিশের পাঁচ সদস্যসহ আটজনের বিরুদ্ধে মামলা হয় আদালতে। চট্টগ্রামের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শাহরিয়ার ইকবালের আদালতে মামলাটি করেন ভুক্তভোগী আইমান রশিদের বাবা হুমায়ুন রশিদ। বাদীর আইনজীবী জুবাইর আলম সাংবাদিকদের বলেন, আদালত বাদীর বক্তব্য গ্রহণ করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা হলেন- পুলিশ কনস্টেবল নুর মোহাম্মদ, আবিদ আল মাহমুদ, আরিফ হোসেন, টিপু দাশ ও নুরনবী। তাদের মধ্যে নুরনবী নগর পুলিশে, অপর চারজন চট্টগ্রাম রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্সে (আরআরএফ) কর্মরত। তাদের সহযোগী সাইফুল ইসলাম, মো. রুবেল ও অপু পাল। স্নাতকপড়ুয়া আইমান রশিদকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী টানেল এলাকা থেকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। দাবি করা হয়েছিল পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা। যারা তুলে নিয়েছিলেন, তারা সবাই পুলিশ সদস্য। তার ভাই পুলিশে কর্মরত, অপহরণকারীরা এটা জানতে পেরে চার ঘণ্টা পর আইমানকে নামিয়ে দেন গরীর সিআরবি এলাকায়। আইমান রশিদের ছোট ভাই নোমান রশিদ ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে কনস্টেবল পদে কর্মরত রয়েছেন। মামলার অভিযোগে বলা হয়, বাদীর বড় ছেলে স্নাতকপড়ুয়া আইমান রশিদ চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলে হাঁটতে বের হন গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর। ওই সময় একটি মাইক্রোবাস এসে তাকে তুলে নিয়ে যায়। গাড়িতে তাকে মারধর করে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। আইমানের পরনে পুলিশের সোয়েটার দেখে তাকে জেরা করেন অপহরণকারীরা। আইমান তার ভাই নোমান রশিদ পুলিশে কর্মরত আছে জানানোর পর অপহরণকারীরা সে বিষয়ে খোঁজখবর নেন। এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে চার ঘণ্টা পর নগরীর সিআরবি এলাকায় আইমান রশিদকে নামিয়ে দেওয়া হয়। পরে মাইক্রোবাসের নম্বরপ্লেটের সূত্র ধরে চালক ও অপহরণকারীদের চিহ্নিত করা হয়। এদিকে আগের দিন মানি লন্ডারিং মামলায় ফাঁসানো ও ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে এক ফ্রিল্যান্সারের কাছ থেকে সাড়ে ৩ কোটি টাকা লুটের ঘটনায় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) উত্তর-দক্ষিণ পরিদর্শক রুহুল আমিন’সহ ৭ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে নালিশি মামলা হয়। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কাজী শরিফুল ইসলামের আদালতে মামলাটি করেন হুসনুম মামুরাত লুবাবা। তিনি ভুক্তভোগী ফ্রিল্যান্সার আবু বকর সিদ্দিকের স্ত্রী। শুনানি শেষে আদালত মামলাটি পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। মামলার অন্য আসামিরা হলেন- ডিবি পুলিশের এসআই আলমগীর হোসেন, মৃদুল কান্তি দে, শাহ পরান জান্নাত, এএসআই বাবুল মিয়া, কনস্টেবল মুমিনুল হক ও আবদুর রহমান এবং জাহিদ হোসেন স্বাধীন। তাদের মধ্যে স্বাধীন ছাড়া অন্য সবাই পুলিশ সদস্য। বাদীপক্ষের আইনজীবী শওকতুল আনোয়ার খান বলেন, ফ্রিল্যান্সার আবু বকর সিদ্দিকের বাড়ি চকরিয়া উপজেলার দরবেশকাটা এলাকায়। নগরীর অক্সিজেন এলাকায় তাদের নিজস্ব বাড়ি রয়েছে। মামলার আরজিতে উল্লেখ করা হয়, গত সোমবার রাত ৩টার দিকে আবু বকরকে ভয় দেখিয়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেন অভিযুক্তরা। এ টাকার মধ্যে দুই ব্যাংক থেকে ৫ লাখ করে ১০ লাখ এবং আরেকটি অ্যাকাউন্ট থেকে ২ লাখ ৭৭ হাজার ডলার (৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা) মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সরিয়ে নেন পুলিশ সদস্যরা। ডিবি পরিদর্শক রুহুল আমিনের নেতৃত্বে একটি টিম এই অপকর্ম করে। এর আগে ৪ মার্চ রাত সাড়ে ১০টার দিকে বায়েজিদ বোস্তামি থানার গুলবাগ আবাসিক এলাকার কয়লার ঘরে বারাকা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি কুলিং কর্নার থেকে আবু বকর সিদ্দিক ও ফয়জুল আমিন ওরফে বেলালকে ফিল্মি স্টাইলে গাড়িতে তুলে নেওয়া হয়। এরপর হ্যান্ডকাফ পরিয়ে ও কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে মনসুরাবাদ গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে নিয়ে তাদের নির্যাতন করা হয়। অভিযুক্ত ডিবির পরিদর্শক রুহুল আমিন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, গত সোমবার রাতে অক্সিজেন এলাকা থেকে দু’জনকে গ্রেফতার করেছিলাম। তাদের আদালতে চালান দেওয়া হয়েছে। টাকা সরিয়ে নেওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি। এসব আমার জানা নেই।

গ্রেফতারের পর পুলিশী নির্যাতনে আহত হয়ে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দির মৃত্যুর ঘটনায় মামলা হয় আদালতে। আদালত দাখিল করা নির্যাতনের অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা নিরূপণের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) দায়িত্ব দিয়েছেন। এ বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলেরও নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত। একইসঙ্গে আদালত অভিযোগকারীকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য ওই সংস্থাকে নির্দেশ দিয়েছেন। মামলার আবেদন দাখিলের ১২দিন গত রোববার চট্টগ্রাম সিনিয়র স্পেশাল জজ বেগম জেবুনেনেছা এ আদেশ দেন। আদালতের কর্মকর্তারা জানান, পিবিআইকে পুলিশ সুপার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তার মাধ্যমে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা তদন্তপূর্বক নিরূপণের আদেশ দিয়েছেন। ২৭ মার্চ প্রিলিমিনারি এনকোয়ারি রিপোর্ট জরুরি ভিত্তিতে দাখিলের জন্য পিবিআইকে আদেশ দিয়েছেন। এ প্রতিবেদন পাওয়া সাপেক্ষে আদালত পরবর্তী আদেশ দেবেন। গত ২০ ফেব্রুয়ারি দাখিল করা মামলার আবেদনে জেল সুপার-ওসিসহ মোট ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। তারা হলেন- বোয়ালখালী থানার ওসি মো. আছহাব উদ্দিন, পরিদর্শক (তদন্ত) সাইফুল ইসলাম, উপ-পরিদর্শক (এসআই) আবু মুসা, সাইফুল ইসলাম ও রিযাউল জব্বার, কনস্টেবল কামাল ও আসাদুল্লাহ, থানায় সে সময় দায়িত্বরত ডিউটি অফিসার এবং কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মুহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন, জেলার এমরান হোসেন মিয়া, ডেপুটি জেলার নওশাদ মিয়া, আখেরুল ইসলাম, সুমাইয়া খাতুন, মো. ইব্রাহিম ও কারা ওয়ার্ড মাস্টার।

কারাগারে মৃত্যু বরণকারী রুবেল দে’র বাড়ি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার শ্রীপুর-খরণদ্বীপ ইউনিয়নের দক্ষিণ জৈষ্ঠ্যপুরা গ্রামে। গ্রেফতারের পর রুবেলকে নির্যাতনের মাধ্যমে মৃত্যু ঘটানোর অভিযোগ এনে তার স্ত্রী পূরবী মামলার আবেদন দাখিল করেন। এতে বলা হয়, গত ২৭ জানুয়ারি বিকেল ৩টার দিকে নিজ বাড়ি থেকে রুবেলকে গ্রেফতার করা হয়। রাত ৮টায় তার বিরুদ্ধে মদ উদ্ধারের ভূয়া মামলা সাজানো হয়। রাত ৯টার দিকে পুলিশ আবেদনকারির মোবাইলে কল দিয়ে রুবেলকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য দুই লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেন। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে ২০০ লিটার চোরাই মদ উদ্ধার দেখিয়ে ভূয়া মামলা করা হয় অভিযোগ করে আবেদনে বলা হয়, পরদিন আদালত রুবেলকে হাজতে পাঠানোর আদেশ দেন। এ সময় গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় প্রিজন ভ্যানে করে তাকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। ২ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রুবেলের পরিবারের সদস্যরা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য কারাগারে যান। কারারক্ষীরা মুমূর্ষু অবস্থায় রুবেলকে হুইল চেয়ারে করে নিয়ে আসেন। তখন রুবেলের কপালে, ডান চোখের ভ্রুয়ের ওপর রক্তাক্ত কাটা জখম এবং মুখমণ্ডলে নীল ফোলা জখম দেখা যায়। তার মুখ দিয়ে অনবরত লালা ঝরছিল। প্রচণ্ড আহত ও নিস্তেজ অবস্থায় কথা বলার শক্তি তার ছিল না। ৫ জানুয়ারি সকাল ৮টায় পূরবী খবর পান, তার স্বামী কারাগারে মারা গেছেন। আবেদনকারীর আইনজীবীর ভাষ্যমতে, টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানানোর পর পুলিশ রুবেলকে মারধর করে নির্যাতন চালায়। এতে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ৪ জানুয়ারি আদালত জেল সুপারকে রুবেলের উন্নত চিকিৎসার জন্য তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন আর রাতেই তার অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়।

সূএ: দৈনিক ইনকিলাব