
যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদের আসন ছাড় দেওয়ার বিষয়টি নতুন করে ভাবাচ্ছে বিএনপিকে। দলটির নেতারা বলছেন, বিএনপির সিদ্ধান্ত হচ্ছে- মিত্রদের বেশকিছু আসনে ছাড় দেওয়া হবে। সেই সংখ্যা কত হবে, তা নিয়ে এখনও চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি দল। কারণ মিত্রদের নিয়ে নির্বাচনী জোট গঠন করলেও আরপিও অনুযায়ী এসব দলকে নিজ নিজ প্রতীকেই নির্বাচন করতে হবে। আর ছাড় দেওয়া আসনে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে বিএনপির মনোনয়নবঞ্চিতরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে পারে। এতে করে কোনো কোনো আসনে জামায়াত বা অন্য কোনো দলের প্রার্থী বিজয়ী হয়ে যেতে পারেন। তাই এভাবে আসন হাতছাড়া করার পক্ষে নয় বিএনপি। এ নিয়ে শিগগির যুগপৎ আন্দোলনের মিত্র রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করবে দলটি। এ ছাড়া জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) আসন ছাড় দেওয়ার বিষয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির নেতাদের মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে।
গত সোমবার রাতে অনুষ্ঠিত জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদের আসন ছাড় দেওয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দলের যাঁরা মিত্রদের সঙ্গে লিয়াজোঁ করছেন, তাঁদের নিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বসবেন। সেখানেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এর আগে বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা মিত্র রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এরই অংশ হিসেবে আজ বৃহস্পতিবার থেকে মিত্রদের সঙ্গে শুরু হচ্ছে বৈঠক। জামায়াতের সঙ্গে কোনো জোট না করার পক্ষে দলটির নীতিনির্ধারকরা। এনসিপির বিষয়ে নীতিনির্ধারকদের মাঝে মতভিন্নতা আছে।
গত ৩ নভেম্বর ২৩৭ আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীদের প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সে সময় তিনি বলেন, আমাদের সঙ্গে যারা যুগপৎ আন্দোলন করেছেন, যেসব আসনে তারা আগ্রহী, সেসব আসনে আমরা কোনো প্রার্থী দিইনি। আমরা আশা করছি তারা তাদের নাম ঘোষণা করবেন, তখন আমরা চূড়ান্ত করব।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুই নেতা বলেন, মিত্র রাজনৈতিক দলের যেসব নেতা সুনির্দিষ্ট আসনে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাদেরই সেসব আসনে ছাড় দেওয়ার পক্ষে তারা। নিশ্চিত পরাজিত হবেনÑ এমন মিত্র নেতাদের নির্বাচন করতে নিরুৎসাহিত করবেন তারা। জনগণের ভোটে সরকার গঠন করতে পারলে যোগ্যতা অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব দেওয়ার মতো সুযোগ থাকবে সরকারের। এ ছাড়া উচ্চকক্ষেও মূল্যায়ন করার সুযোগ থাকবে। কিন্তু নির্বাচনে পরাজিত হলে আর কোনো সুযোগ থাকবে না।
বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে, দলের নীতিনির্ধারণী নেতারা নিজেরা শরিক দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের প্রার্থিতার বিষয়টি নানাভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করছেন। বিশেষ করে গণতন্ত্র মঞ্চ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ১২ দলীয় জোট, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), গণঅধিকার পরিষদ, এলডিপি, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), বাংলাদেশ লেবার পার্টি ও গণফোরামের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের জন্য আসন ছাড় দেওয়া হতে পারে।
মিত্র রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতা বলেন, বিএনপি ৬৩টি আসন ফাঁকা রেখে ২৩৭ আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু ৩০০ আসনেই তাদের নেতারা প্রচারে নেমে পড়েছেন। এর ফলে জোটের জন্য যেসব আসন রাখা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, সেখানেও মিত্রদলের সম্ভাব্য কোনো প্রার্থী প্রচার চালাতে পারছেন না। এটা নিয়ে তারা বেশ চিন্তিত। তাদের ভাষ্য মতে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ইচ্ছা থাকলেও ঢাকার নেতাদের মনে হয় একটু অনীহা রয়েছে।
১২ দলীয় জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা বিএলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদত হোসেন সেলিম আমাদের সময়কে বলেন, আমরা যারা ধানের শীষের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করব, তাদের প্রার্থিতা ঘোষণা দিলেই হয়।
এদিকে জুলাই আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের দল এনসিপির সঙ্গে নির্বাচনী জোট করার বিষয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে ভিন্নমত আছে বলে জানিয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ থেকে থেকে ’৯০-এর গণ-অভ্যুত্থান পর্যন্ত যতগুলো আন্দোলন হয়েছে, সবগুলোর সম্মুখভাগে ছিলেন ছাত্ররা। আন্দোলন শেষে ছাত্ররা পড়াশোনায় ফিরে গেছেন, তারা সরকারের অংশ হননি। কিন্তু এবার আন্দোলনের পর ছাত্রদের সরকারের অংশ করায় তাদের সম্পর্কে নানা অভিযোগ উঠেছে। বিএনপিও যদি এমন কাজ করে তবে তা যথার্থ হবে না।
বিএনপি ও এনসিপির মধ্যে নির্বাচনী সমঝোতা হচ্ছে কিনা, জানতে চাইলে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রাজনীতিতে এসব বিষয়ে শেষ কথা তো বলা যায় না। তবে এখনও পর্যন্ত বিএনপির সঙ্গে অন্যান্য রাজনৈতিক দল, যারা যুগপৎ আন্দোলনে ছিল, এর বাইরে যারা গণতান্ত্রিক সংগ্রামে ছিল, কিছু ইসলামিক দলসহ আমরা আরও কিছু দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করতে চাই।
এনসিপির সঙ্গে আলোচনার খবর অস্বীকার করলেও সমঝোতার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতে চান না সালাহউদ্দিন। তিনি বলেন, এখনও পর্যন্ত এনসিপির সাথে জোটবদ্ধ হব কি হব না বা তারা আমাদের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে ইলেকশন করবে কি করবে না, সেটার কোনো প্রস্তাব তাদের পক্ষ থেকেও আসেনি, আর আমাদের পক্ষ থেকেও যায়নি। তবে সেই সমঝোতা বা সেই জোট যে হবে না-তাও বলা যায় না। সে জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে।
বিএনপির মিত্র রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বলছেন, এখন নভেম্বর মাস চলছে। নির্বাচনের আগে সময় আছে ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাস। যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের মনোনয়ন নিশ্চিত না করায় তাঁরা অস্থিরতার মধ্যে রয়েছেন। অনেকে নির্বাচনী এলাকায় সেভাবে কাজ করতে পারছেন না। আবার জোটের প্রধান দল হিসেবে সম্ভাব্য আসনগুলোতে শরিক দলের নেতারা স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীদের সে রকম সহযোগিতা পাচ্ছেন না। তাঁরা বিএনপির সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছেন। অনেকে ব্যক্তিগতভাবে দলের নীতিনির্ধারণী নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।
গতকাল বিএনপির এক আলোচনাসভায় এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু সমঝোতার প্রস্তাব দিয়ে বলেন, ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫০ আসনে বিএনপি জোট ও জামায়াত জোট সমঝোতার ভিত্তিতে প্রার্থী দেবেন। বাকি ১৫০ আসন থাকবে উন্মুক্ত। যে ১৫০ আসনে? সমঝোতা হবে তাতে বিএনপি জোট ১০০ আসনে এবং জামায়াত জোট ৫০ আসনে সমঝোতার ভিত্তিতে প্রার্থী দেবেন। বাকি ১৫০ আসনে সবাই সবার মতো করে প্রার্থী দেবেন। যদিও তার এ প্রস্তাব নিয়ে বিএনপির দিক থেকে কোনো মন্তব্য আসেনি।
সূত্র : যুগান্তর












































