দুই দিন আগের কথা। রাত তখন বাজে ১১টা। শীতের রাতে হুট করেই আবাসিক এলাকায় নেমে এসেছিল নৈঃশব্দের চাদর। চারদিকে সব চুপচাপ। হঠাৎ করে প্রবল শব্দে ভেঙে পড়ল যেন সব! চারপাশের চরাচরে আবির্ভূত হল ধুড়ুম ধুড়ুম শব্দ।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে গভীর রাতের অন্ধকারে হুট করে এমন ধুড়ুম ধুড়ুম শব্দ শুনলে যে কারও আতঙ্কিত হওয়া স্বাভাবিক। ঘটনার আকস্মিকতায় এই বান্দাও তার ব্যতিক্রম নয়। দৌড়ে বাসার বারান্দায় যাওয়ার পর আশপাশের প্রতিবেশীদের কিছু আনাগোণাও চোখে পড়ল। তারাও বারান্দায় এসে বিকট শব্দের উৎস খোঁজার চেষ্টা করছিলেন। কিছুক্ষণ পর মোড়ের জটলা দেখে ও কেয়ারটেকারের দেওয়া তথ্য মারফত এবং নিজের শব্দ বিশ্লেষণের যৎসামান্য ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে বোঝা গেল যে, হয় পটকা নাহয় আতশবাজি ছিল সেটি। ইংরেজি নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার প্রস্তুতি হিসেবেই কেউ হয়তো এসব ফুটিয়ে হাতের একটু মকশো করে নিচ্ছিল!
ইংরেজি নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার চল সারা পৃথিবীতেই আছে। সেই বরণ করে নেওয়ার ক্ষেত্রে আতশবাজি বা পটকা ফোটানো এবং ফানুস ওড়ানোর প্রথাও বিশ্বব্যাপীই প্রচলিত। আমাদের দেশেও হয়। তবে গত কয়েক বছর ধরেই সরকারের পক্ষ থেকে থার্টি ফার্স্ট নাইটে আতশবাজি ও ফানুসের ব্যবহার নিয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে। এ বছরও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে দেওয়া নির্দেশনায় এরই মধ্যে বলা হয়েছে যে, কোনো উন্মুক্ত স্থানে আতশবাজি, পটকা ও ফানুস ওড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে। ওদিকে থার্টি-ফার্স্ট নাইট ও ইংরেজি নতুন বছর উদযাপন উপলক্ষে এমআরটি-৬ এর রুট অ্যালাইনমেন্ট ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ফানুস বা অনুরূপ কোনো বস্তু না ওড়ানোর অনুরোধ করেছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।
আর শব্দদূষণ রোধ এবং জনস্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব বিবেচনায় ইংরেজি নববর্ষে আতশবাজি ও পটকা ফোটানো থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, ইতোপূর্বে এক থার্টি ফার্স্ট নাইটে আতশবাজির শব্দে ভয় পেয়ে হৃদরোগে ভুগতে থাকা এক শিশুর মৃত্যু হয় বলে খবরে প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়াও অতিরিক্ত শব্দের কারণে শ্রবণশক্তি ও স্মরণশক্তি হ্রাস, ঘুমের ব্যাঘাত, দুশ্চিন্তা, উগ্রতা, উচ্চ রক্তচাপ, কান ভোঁ ভোঁ করা, মাথা ঘোরা, হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়া, মানসিক অস্থিরতা, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়াসহ মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে। এমতাবস্থায় ইংরেজি নববর্ষ উপলক্ষে থার্টি ফার্স্ট নাইটে জনস্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর এ ধরনের বিধিবহির্ভূত কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার জন্য সকলকে অনুরোধ করা হয়েছে। এছাড়া প্রচলিত আইনের উল্লেখ করে মন্ত্রণালয় বলেছে, শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬-এর ৭ বিধি লঙ্ঘন করে অননুমোদিতভাবে ইংরেজি নববর্ষ উপলক্ষে থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপনের সময় আতশবাজি ও পটকা ফাটালে তা বিধিমালার ১৮ বিধি অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য। সুতরাং দোষী সাব্যস্ত হলে জেল–জরিমানাও হবে।
আতশবাজি ও পটকা ফোটানো থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে নানা পোস্ট ও ইভেন্ট দেখা যাচ্ছে। পরিতাপের বিষয় হলো, এসবে আগ্রহী মানুষ যেমন আছেন, তেমনি এর বিরোধিতাকারী মানুষও আছেন অনেক। বিরোধিতাকারীরা গণহারে এসব পোস্ট ও ইভেন্টে গিয়ে ‘হা হা’ রিয়্যাকশন দিচ্ছেন। অনেকে এটিকে ‘চ্যাতনা’ আখ্যায়িত করে বিরূপ মন্তব্য ও পোস্ট লিখছেন। যে কেউ যে কোনো কিছু লিখে নিজের মতামত জানাতেই পারেন অবশ্য। আমাদের দেশের সংবিধান সেই মত প্রকাশের অধিকার সব নাগরিককেই দিয়েছে। তবে এর মধ্য দিয়ে আমাদের নাগরিকদের একটি বিরাট অংশের এক অদ্ভুত ও ক্ষতিকর মানসিকতাও সামনে চলে আসছে বটে।
এই দুনিয়ায় বাস করা একমাত্র প্রাণি নয় মানুষ। পাখি আছে, আছে ছোট–বড় আরও নানা ধরনের প্রাণি। তবে সময়ের সাথে সাথে মানুষ অন্যান্য প্রাণিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে নিজেকে ধীরে ধীরে ‘অ্যাপেক্স প্রিডেটর’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সেই সঙ্গে এ পৃথিবীকে নিজেদের ইচ্ছে ও সুবিধে মতো ব্যবহারের স্বেচ্ছাচারও জারি করেছে মানুষ। ফলে যেটি হয়েছে, সেটি হলো অন্যান্য প্রাণি ও উদ্ভিদকূল নিজেদেরকে পুরোপুরি একঘরে হিসেবে আবিষ্কার করছে প্রতিনিয়ত। দেরিতে হলেও অবশ্য মানুষের কিছু অংশ বুঝতে পেরেছে যে, সবাইকে (মানে সব প্রাণি ও উদ্ভিদ জগৎ) নিয়ে বাঁচার অভ্যাস গড়তে না পারলে এই দুনিয়াটিকেও টেকানো কঠিন হয়ে যাবে। তাই অনেকটা নিজেদের টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই মানুষ প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক প্রাণ–পরিবেশ সংরক্ষণে এখন সচেষ্ট হওয়ার চেষ্টা করছে। অথচ এখনও যে অনেক মানুষই এমন সংরক্ষণের বিরুদ্ধে, তা আশপাশের চেনাজানা গুটিকতক মানুষের সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যাবে। আর সেই প্রতিক্রিয়া থেকেই আতশবাজি, পটকা ফোটানো বা ফানুস ওড়ানোর অপকারিতা বোঝাতে গেলে গায়ে লাগাতে হয় ‘চ্যাতনাধারী’ বা ‘পরিবেশজীবী’ ঘরানার অহেতুক ব্যঙ্গাত্বক ট্যাগ।
আতশবাজি, পটকা ফোটানো বা ফানুস ওড়ানোর অপকারিতা নিয়ে বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের দেওয়া এ বছরের সতর্কতামূলক বিজ্ঞপ্তির অনেকটাই এই লেখার শুরুর দিকে দেওয়া হয়েছে। সেটি পড়লে নিশ্চয়ই বোঝা যায় যে, শুধু পাখি নয়, বরং মানুষের নিজেদের জান বাঁচানোর জন্যই এসব ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন। আতশবাজি, পটকা ফোটানো বা ফানুস ওড়ানোয় শব্দ ও বায়ু দূষণও হয় ব্যাপক। ফানুস ওড়ানোর ফলে অগ্নিকাণ্ড ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হয়। আমাদের দেশের রাজধানী বা অন্যান্য শহরে যেভাবে আমরা প্রায় গায়ে গা ঘেঁষে বাস করি, সেখানে দাউ দাউ করে আগুন লাগলে অবস্থা কেমন হবে বলে মনে হয়? নিশ্চয়ই সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ও তাতে নিহতের পরিমাণ আমাদের স্মৃতিতে কিছুটা হলেও আছে!
আরও কিছু তথ্য যোগ করা যাক। আতশবাজি বা পটকার বিকট শব্দের কারণে স্রেফ হার্ট অ্যাটাকে মারা যায় পাখি। ২০২১ সালের থার্টি ফার্স্ট নাইটে বিকট শব্দে আতশবাজি ফোটানোর কারণে ইতালির রোম শহরে কয়েক হাজার পাখি মরে রাস্তায় পড়ে ছিল। এই পাখিগুলো মরে গিয়েছিল হার্ট অ্যাটাকেই। বৃদ্ধ মানুষ ও শিশুরাও এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যাপকভাবে। আমাদের দেশেই আতশবাজি বা পটকার বিকট শব্দে শিশুর প্রাণ হারানোর মতো মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। আর আতশবাজি বা পটকা প্রাণ–পরিবেশের পাশাপাশি একেবারে সুস্থ–স্বাভাবিক মানুষের স্বাস্থ্যের জন্যও প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিকর। এগুলো তৈরিতে ব্যবহার করা হয় মূলত কার্বন ও সালফার। আরও ব্যবহার করা হয় পটাশিয়াম নাইট্রেট, অ্যালুমিনিয়াম ও বেরিয়াম নাইট্রেট। এইসব মিলে তৈরি হয় কার্বন মনো-অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড ও সালফার ডাই-অক্সাইডের মতো বিষাক্ত গ্যাস, যেগুলো মানুষের দেহে প্রবেশ করে ক্যানসারসহ নানা রোগের সৃষ্টি করে।
অর্থাৎ, ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন করতে গিয়ে আতশবাজি, পটকা ফোটানো বা ফানুস ওড়ানোর মধ্য দিয়ে আমরা আসলে যে কেবল অন্যের ক্ষতি করছি, তা নয়। বরং নিজেদেরও ক্ষতি ডেকে আনছি। তা আনন্দ করতে গিয়ে যদি আমরা মরেই যাই বা মরে যাওয়ার মতোই অবস্থা তৈরি হয়, তবে নতুন বছরটা যাপন করবে কে?
আর এ দেশে যেসব মানুষ পাখির মতো অন্যান্য প্রাণিদের মৃত্যুকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে এক দিনের আনন্দ–উৎসবের স্বেচ্ছাচারী মানসিকতাকে সমর্থন জানান, তাদের প্রতি একটি কথা। আপনারা হয়তো শুধু মানুষ মেরে ফেলাকে খুন বা হত্যা মনে করেন। কিন্তু আদতে আপনার কারণে যদি একটি পাখিরও মৃত্যু হয়, তাহলেও প্রাণ হত্যার দায় আপনার ওপরেই আরোপিত হয়। সেক্ষেত্রে আপনিও খুনী, হত্যাকারী।
তা বছরের শেষ দিনটায় কি খুনীই হতে চান?
লেখক: উপবার্তা সম্পাদক, ডিজিটাল বিভাগ, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |