প্রচ্ছদ হেড লাইন দাদাদের অঙ্কে মাথা কাঁচা

দাদাদের অঙ্কে মাথা কাঁচা

হেড লাইন: বাংলাদেশীদের চিকিৎসাসেবা না দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন ভারতের চিকিৎসকেরা। আর বাংলাদেশীদের হোটেলে রাখবেন না বলেছিলেন হোটেল মালিকরা। অপরাধ, বাংলাদেশে ভারতের পতাকার অবমাননা, সংখ্যালঘুদের ওপর অবিচার, বিশেষ করে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর জামিন নামঞ্জুর। তবে তাদের জানা নেই যে, চিন্ময়ের জামিন ঘিরে তার অনুসারীদের সশস্ত্র হামলায় একজন তরুণ আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ খুন হয়েছেন। এরপর থেকেই দুই দেশের মধ্যে একের পর এক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। ক‚টনৈতিক সম্পর্কে তীব্র টানাপড়েন চলছে। অবশ্য, ৫ আগস্ট ভারতের অনুগত শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে দিল্লির বৈরী আচরণ দিন দিনই বাড়ছিল। অথচ ফ্যাসিস্ট হাসিনা জমানায় ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের কর্মীরা বিশ্বজিৎ দাসকে বিনা কারণে প্রকাশ্য দিবালোকে শত শত মানুষ ও আইনরক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং সাংবাদিকদের সামনে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। ওই ঘটনার বিচারে নিম্ন আদালতে আটজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার পর উচ্চতর আদালত ছয়জনকে খালাস দেন, পরিশেষে গত ১১ জুলাই ২০১৭ বাকি দু’জনও খালাস পান। বিস্ময়ের বিষয় হলো, বিশ্বজিৎ হত্যার ঘটনায় ভারত কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখায়নি। আর রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় চিন্ময়ের জামিন নামঞ্জুরে দেখাল চরম ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া।

দাদাদের অঙ্কে মাথা কাঁচা। কারণ ‘সরকারি চাকরি ও শিক্ষাক্ষেত্রে সংখ্যালঘু মুসলিমদের জন্য ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যে যে আলাদা সংরক্ষণ বা কোটার ব্যবস্থা আছে তা নিয়েও ভোটের আগে আলোচনা তুঙ্গে ওঠে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমিত শাহ এক সভায় মুসলিমদের জন্য এ কোটাকে অসংবিধানিক বলে উল্লেখ করেছেন।’ (বিবিসি নিউজ দিল্লি ২৪ এপ্রিল ২০২৩) ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, ভারতে যে ১৫ শতাংশ মুসলমান রয়েছে অসংবিধানিক বলে কোটা তুলে দিলে সরকারি চাকরির ১৫ শতাংশ কোটা থেকেও বঞ্চিত হবে মুসলিমরা। অথচ ‘বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র আট শতাংশ সংখ্যালঘু হলেও সরকারি চাকরিতে রয়েছে ২৫ শতাংশ সংখ্যালঘু। (ইনকিলাব ৩০ নভেম্বর ২০২৪)। বাংলাদেশীদের চিকিৎসাসেবা না দেয়াসহ হোটেল রেস্টুরেন্ট বন্ধ করার ঘোষণা দেয়ার আগে দাদাদের আমলে নেয়া উচিত ছিল, তাদের চিকিৎসালয় ও চিকিৎসালয় ঘিরে স্থাপিত হোটেল রেস্টুরেন্ট বাংলাদেশ থেকে বছরে কত টাকা আয় করে। বাংলাদেশের মধ্যবিত্তশ্রেণী ভারতে চিকিৎসাসেবা নিতে যায়। এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে শুধু বাংলাদেশ থেকে রোগী গেছে এক লাখ ৬৫ হাজার। তারা খরচ করেছেন দুই হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা। এ বছর সারা বিশ্ব থেকে ভারতে আসা রোগীদের মোট খরচ ছিল সাত হাজার ১১৫ কোটি টাকা। ভারতের সরকারি উপাত্ত বলেছে, দেশটিতে চিকিৎসাসেবা নেয়া প্রতি তিনজনের একজন বাংলাদেশী।

ভারতে কেন বাড়ছে রোগীর সংখ্যা? এ প্রশ্নের প্রথম উত্তর অনেকের মতে- বিশ্বাস, ব্যবহার ও আচরণ। বিশ্বাস, ব্যবহার আর আচরণ বাংলাদেশী রোগীদের টেনে নেয় বিদেশে। তিনটি বিষয় ছাড়াও রয়েছে ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা। দেশের পরীক্ষার ওপর অনাস্থা অন্যতম কারণ। যেমন ভারতে চিকিৎসাসেবা নেয়া আনোয়ারা সদরের ব্যাংকার নুরুল আলমের কথাই ধরা যাক। প্রায় চার বছর আগে তিনি বুকে ব্যথা অনুভব করেন। দুই বছর চট্টগ্রাম ও ঢাকার নামকরা বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েও সুফল পাননি। পরে কলকাতায় ডা: দেবী শেঠির ইনস্টিটিউটে গেলে তারা কিছু পরীক্ষ-নিরীক্ষা দেন। প্রতিবেদন দেখে ডাক্তার জানান, হার্টে কোনো সমস্যা নেই। তাকে ১৩০ রুপির ওষুধ দেন। সেই ওষুধ খেয়ে নুরুল আলম এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন জানায়, তারা ২০১৭ সালে এক লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশীকে মেডিক্যাল ভিসা দিয়েছে। এ সংখ্যা ২০১৬ সালের চেয়ে দ্বিগুণ। ২০১৫ ও ২০১৬ অর্থবছরে ভারতে চিকিৎসা নেয়া চার লাখ ৬০ হাজার রোগীর মধ্যে এক লাখ ৬৫ হাজার ছিল বাংলাদেশী। অনেকে ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়েও চিকিৎসা করান।

বিদেশীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে ভারতের মোট আয়ের ৫০ শতাংশ আসে শুধু বাংলাদেশ থেকে। ভারতে রোগী যাওয়ার আরো কারণ, বাংলাদেশের মানুষের আয় বৃদ্ধি; সহজে ভিসা প্রাপ্তি; যাতায়াতে তুলনামূলক স্বল্প ব্যয়। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের এক রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশীরা বিদেশে চিকিৎসা করাতে বছরে ব্যয় করেন প্রায় ২০৪ কোটি টাকা। এ অর্থ বাংলাদেশের মোট আয়ের ১ দশমিক ৯৪ শতাংশ। একই চিকিৎসায় বাংলাদেশে যে ব্যয় হয় তার চেয়ে ভারতে ব্যয় হয় দ্বিগুণ অর্থ। থাইল্যান্ডে ও সিঙ্গাপুরে দৃশ্যত তিন থেকে ১০ গুণ ব্যয় হলেও হাসপাতালের বিল, কেবিন খরচসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় হিসাব করলে ভারত আর থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরে চিকিৎসার ব্যয় প্রায় একই দাঁড়ায়। ফলে দেশের হাসপাতালগুলোর প্রতি অনাগ্রহ বাড়ছে। দেশের হাসপাতালে চিকিৎসায় অবহেলা, গাফিলতি এবং ভুল চিকিসার অভিযোগ আছে। গলাব্যথা নিয়ে ২৮ জুন ২০১৮ চট্টগ্রাম ম্যাক্স হাসপাতালে ভর্তি হয় একজন সাংবাদিকের আড়াই বছর বয়সী শিশুকন্যা। পরদিন রাতে সে মারা যায়। অভিযোগ ওঠে, কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সদের অবহেলা মৃত্যুর জন্য দায়ী। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। তদন্ত প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, ম্যাক্স হাসপাতালে রোগীদের ভোগান্তি প্রকট। চিকিৎসক ও নার্সদের সমন্বয় নেই। অদক্ষ নার্স ও অনভিজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগে এ হাসপাতালে কাক্সিক্ষত চিকিৎসাসেবা পান না রোগীরা। বিবিসিতে এ নিয়ে রিপোর্ট প্রচারিত হয়। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত রোগী বা স্বজনরা আইনি প্রতিকার তেমন একটা পান না। কারণ চিকিৎসার ভুল আদালতে প্রমাণ করা প্রায়ই কঠিন হয়ে পড়ে। প্রবাদ আছে, ‘প্রয়োজনীয়তা উদ্ভাবনের জননী’। এ দেশের মানুষ ভারতে চিকিৎসা করানোর সুযোগ না পেলে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় বিদ্যমান সমস্যা দূর হয়ে যাবে। তখন চিকিৎসাসেবা নিয়ে এ দেশের মানুষের কষ্ট লাঘব হবে।

লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
adv.zainulabedin@gmail.com

প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে।