অপরাধ: সিনেমার গল্পকেও হার মানায় এ কাহিনী। একে একে বিয়ে করেছেন ১২টি। নিজেকে মডেল আর অভিনেত্রীর পরিচয় দেন। অবশ্য ইউটিউবার হিসেবেও কাজ করেন আসলে বিয়ে করাই তার নেশা। টুঙ্গিপাড়ার কোটালীপাড়ার মেয়ে ডালিয়ার এ কাহিনী এখন একে একে ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। যা নিয়ে চলছে কানাঘুষা। কখনো ডালিয়া আক্তার সাথী, কখনো ডালিয়া খানম, আবার কখনো মায়া নামে পরিচয় দেন। মায়া নামের প্রতি যেন অবিচার করেননি। তাইতো মায়া জালে ফেলে শিকার করেন একের পর এক যুবককে। ফাঁদে ফেলে বিয়ে করে গড়েছেন কোটি টাকার সম্পদ।
স্বামীর তালিকায় রয়েছেন র্যাব সদস্য, আনসার সদস্য, পুলিশ কনস্টেবল, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, বেসরকারি চাকরিজীবী, প্রবাসীসহ আরও অনেকেই। ডালিয়ার ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন প্রত্যেকেই। চাকরি হারিয়ে র্যাব সদস্য এখন মুদি দোকানি। আনসার সদস্য এখন অটোরিকশা চালক। প্রথম স্বামী ডালিয়ার নির্যাতন থেকে বাঁচতে দেশে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ফেলে ভারতে পালিয়ে যায়। বর্তমানে তিনি নিঃস্ব। মানবজমিনের অনুসন্ধানে এখন পর্যন্ত ডালিয়ার ১২টি বিয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে। গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার কুশলা ইউনিয়ন। এই কুশলায় বেড়ে উঠেছেন ডালিয়া।
পড়েছেন মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। ডালিয়ার ছোট ভাই, তার তিনজন সাবেক স্বামী এবং বর্তমান স্বামী, বিয়ের কাজী, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানসহ অনেকেই ডালিয়ার বেপরোয়া জীবন ও বিয়ে বাণিজ্য নিয়ে কথা বলেছেন। তার বিয়ে বাণিজ্য এবং বেপরোয়া জীবনের যাবতীয় নথি মিডিয়ার হাতে এসেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, একের পর এক বিয়ের পর স্বামীকে নির্যাতন শেষে দেনমোহরের টাকা নিয়ে দেন ডিভোর্স। এভাবেই ১২ জন স্বামীর কাছ থেকে কথিত মডেল ডালিয়া হাতিয়েছেন কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, এক প্রবাসীকে সঙ্গে বিয়ে করে সৌদি আরবে ভাইসহ পাড়ি জমিয়েছিলেন। তিনি ডালিয়ার ১২তম স্বামী। জানা গেছে, সৌদি যাওয়ার আগে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাচ করতেন। অসামাজিক অভিনয় করেন নাম সর্বস্ব কিছু ইউটিউব চ্যানেলে। এসব থেকেই বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে পরিচয়। এরপরই খুলে বসেন বিয়ের দোকান। ডালিয়া মাত্র ৩২ বছর বয়সে ১২ জনকে বিয়ের ফাঁদে ফেলেন। ডালিয়ার প্রথম স্বামী সোহেল খান, বাড়ি টুঙ্গিপাড়ার কোটালিপাড়ায়। দ্বিতীয় স্বামী হুমায়ুন তার বাড়িও টুঙ্গিপাড়ার কোটালিপাড়া। ৩ নম্বরে রয়েছে টাঙ্গাইলের সোহাগ। চতুর্থ রিপন মণ্ডল, ৫ম স্বামী হবিগঞ্জের আনসার সদস্য সুনির্মল বিশ্বাস, ৬ষ্ঠ খুলনার আমিরুল ইসলাম (র্যাবের সাবেক সার্জেন্ট) ৭ম কনস্টেবল মো. রাজু আহমেদ, ৮ম সিরাজগঞ্জের আব্দুল খালেক- মালয়েশিয়া প্রবাসী। ৯ম বরিশালের রেজাউল শেখ, ১০ম যাত্রাবাড়ীর শাহ আলম, ১১তম নরসিংদীর সৌদি প্রবাসী এনামুল ১২তম স্বামী ওমান প্রবাসী সাকিব। অবশ্য এ ব্যাপারে ডালিয়া বলেন, আমার নামে আনা সকল অভিযোগ মিথ্যা। আমাকে বিদেশে পাচার করার চেষ্টা করেছিল সর্বশেষ স্বামী। তবে এখন পর্যন্ত তিনি ৩ থেকে ৪টি বিয়ে এবং তালাকের কথা শিকার করেছেন। প্রত্যেকেই তার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।
ডালিয়ার বিয়ে বাণিজ্যের এ ব্যাপারে তার আপন ছোট ভাই হাসিবুর শেখ বলেন, আমার বোন ভালো না। ভেজাল আছে। সমস্যা আছে। তিনি আমাদের কথা শোনেন না। বেপরোয়া। এখন পর্যন্ত তার চারটি বিয়ে এবং ডিভোর্সের খবর শুনেছি। আমার বাবা তিন বিয়ে করেছেন। ডালিয়া আমার আপন বোন। চার ভাই বোনের মধ্যে তিনি বড়। বাবা বোনের টাকায় চলেন তাই ডালিয়াকে কিছু বলেন না। আমরা তার জন্য এলাকায় মুখ দেখাতে পারি না। তার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমি আমার আরেক বোনের বাসায় থেকে পড়াশোনা করি। ডালিয়া গত আট বছর ধরে ঢাকার নবাবগঞ্জ এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। সেখানে ডালিয়ার কথিত স্বামী আনোয়ারকে নিয়ে থাকেন। তিনিই নাকি একের পর এক বিয়ের পাত্র খুঁজে দেন। বেশ কয়েকটি বিয়ের সাক্ষীও তিনি। পল্টনের শাওন টাওয়ার অফিসের ডিরেক্টর হুমায়ুনের মাধ্যমেও একটি বিয়ে হয় ডালিয়ার। তিনি ডালিয়াকে দেড় লাখ টাকা খরচ করে ঘরের আসবাবপত্র কিনে দেন। ডালিয়ার বাসায় বেশ যাতায়াত ছিল তার। কুশলা ইউনিয়নের পাশের ইউনিয়ন হিরণ। এখানেই ১৫ বছর আগে বিয়ে হয় ডালিয়ার। স্থানীয় লোয়ারংকে বাজারে টেইলারের দোকান দেন প্রথম স্বামী সোহেল।
সোহেল বলেন, ডালিয়ার পরকীয়ায় আসক্তি এবং তার নির্যাতন থেকে জীবন বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারত ছিলেন ৬ মাস। তিনিই ডালিয়ার প্রথম শিকার। এরপর নিজের গ্রামের প্রবাসী হুমায়ূনের সঙ্গে বিয়ে হয় ডালিয়ার। তিনি দ্বিতীয় স্বামী। কুলশা বাজারে ডিশ ইন্টারনেট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হুমায়ূনের ৮ বছরের একটি মেয়েও রয়েছে। হুমায়ূনকে রেখেই অন্য পুরুষে আসক্ত হয়ে ওঠেন ডালিয়া। তাকে রেখেই পাশের গ্রামের আরেকজনের সঙ্গে পালিয়ে যায় ডালিয়া। এসব ঘটনার পর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ পুরো নিঃস্ব হয়ে যায় হুমায়ূনের জীবন। বর্তমানে তার মেয়ে ডালিয়ার সঙ্গেই থাকে।
টাঙ্গাইল জেলার ধনবাড়ী এলাকার স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত সোহাগ। কয়েক বছর আগে এলাকার সাংস্কৃতিক এক নাচের অনুষ্ঠানে যোগ দেয় ডালিয়া আক্তার সাথী। ২০২০ সালে সেই অনুষ্ঠানেই পরিচয়। পরবর্তীতে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন সোহাগ। এক সময় আংটি বদল হয় তার সঙ্গে। ডালিয়া বিয়ে করেন সোহাগকে। ডালিয়ার দীর্ঘদিনের পরিচিত রহমতুল্লাহ জানায়, সোহাগের সঙ্গে বিয়ে হয় ডালিয়ার। যদিও সোহাগ দাবি করেন তার সঙ্গে বিয়ে হয়নি। তবে গভীর সম্পর্ক ছিল। টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীতে আরেক স্বামীর খোঁজ মেলে। এখানে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করেছেন ডালিয়া। রতন মণ্ডলের সঙ্গে বিয়ের পর ডিভোর্সের ১ লাখ টাকায় রফাদফা হয়। রতন মণ্ডল তাদের বিয়ে ও ডিভোর্সের দুটি ছবি সরবরাহ করেন। যেখানে ডালিয়া ডিভোর্স পেপারে সাইন করছেন। পরের ছবিতে তিনি টাকা নিচ্ছেন। ডালিয়ার বিয়ের ব্ল্যাকমেইলের ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন সেনাবাহিনীর এক সদস্য। সেনাবাহিনীতে চাকরিচ্যুত হয়ে বাড়িতে তিনি এখন মুদি দোকানদার। ছেলের বউয়ের এমন কর্মকাণ্ড সইতে না পেরে তার বাবা মারা যান। মামলার আসামিও ছিলেন তিনি।
সেনাবাহিনীর সার্জেন্ট (র্যাব) চাকরিচ্যুত অফিসার আমিনুলের বাড়ি খুলনা শহর থেকে জেলখানা ফেরিঘাট ও রূপসা নদী পার হয়ে রূপসা থানার জুগিরহাট গ্রামে। চাকরি হারিয়ে এখন মুদি দোকানের মালিক আমিনুল। আমিনুল সেনাবাহিনী থেকে বদলি হয়ে আসেন র্যাব সদরদপ্তরে। তার অধীন আনসার সদস্য সুনির্মলকে বিয়ে করেন ডালিয়া। এ নিয়ে দেন ধর্ষণ মামলা। সেই মামলার রফাদফা করার দায়িত্ব পান তৎকালীন র্যাবের সার্জেন্ট আমিনুল। আর সেই বিচার করতে গিয়ে ডালিয়ার পাতা ফাঁদে পা দেন আমিনুল। এক সময় বিয়ে করতে বাধ্য হন ডালিয়াকে। এরপরই পুরনো কৌশলে হাতিয়ে নেন টাকা। করেন নারী নির্যাতন মামলা। সেই শোকেই মারা যান আমিনুলের বাবা। আমিনুল বলেন, চাকরিরত থাকলে এখন আমি সার্জেন্ট থেকে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে প্রমোশন পেতাম। কিন্তু ডালিয়ার ফাঁদে পড়ে আমার জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে। বিয়ের পর ডালিয়ার বাবাকে ব্যবসা করার জন্য ৮ লাখ টাকা দেন। বাসার আসবাবসহ অসংখ্য টাকা ব্যয় করেন। এই টাকা উদ্ধারে ব্যর্থ হয়ে বর্তমানে একটি প্রতারণা ও অর্থ উদ্ধার মামলা চলমান রয়েছে। সেই মামলায় ডালিয়ার বাবা লিয়াকত ১ মাস জেল খেটেছেন।
স্থানীয়রা জানায়, ডালিয়া বিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া টাকায় গ্রামে বাড়ি কিনেছেন। রয়েছে কোটি টাকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। যার দেখাশোনা করেন ডালিয়ার বাবা নিজেই। বাবা লিয়াকত মেয়ে ডালিয়ার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগও অস্বীকার করেন। জামাইয়ের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া সম্পদ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, সকল অভিযোগ মিথ্যা। আমার মেয়েকে এখন পর্যন্ত তিনটি বিয়ে দিয়েছি এর বাইরে বাকি বিয়ের বিষয়ে আমার জানা নেই। কুশলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুলতান মাহমুদ বলেন, ডালিয়ার এখন পর্যন্ত ১০টি বিয়ের খবর তিনি জানেন। এলাকায় তার বিয়ে এবং বিয়ে বাণিজ্যর বিষয়টি সকলেরই জানা। ডালিয়ার ১২টি বিয়ের পরও তিনি কাবিননামায় কুমারী লেখেন। কাবিন নেন ১০ লাখ টাকা। তার ফাঁদে পড়ে আনসার সদস্য সুনির্মল বিশ্বাস চাকরি হারিয়েছেন। এখন তিনি আটোচালক। আরেক স্বামী কাবিনের টাকার বিপরীতে মোটরসাইকেল ও ভিটাবাড়ি হারিয়েছেন। রেজাউলকে যখন বিয়ে করেন তখন মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে তিনটি বিয়ে করেছেন ডালিয়া।
রেজাউল বলেন, আমাকে ফাঁদে ফেলে ডালিয়া বিয়ে করেন। তার জন্য আমার চাকরি গেছে। মোটরসাইকেল ও গ্রামের জমি বিক্রি করে দিয়ে ওর হাত থেকে মুক্ত হয়েছি। আমার সঙ্গে বিয়ের পর তার ৯টি বিয়ের তথ্য পাই। এভাবেই জানান বরিশালের যুবক ও তার ৯ম স্বামী রেজাউল। তার সঙ্গে বিয়ের কাবিনের কপিতে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে- ডালিয়া কুমারী। বিয়ের কিছুদিনের মধ্যে ডিভোর্স চায় ডালিয়া। এমনকি নির্যাতনও করা হয় তাকে। পরে বাবার জমি বন্ধক রেখে ১ লাখ টাকাসহ নিজের মোটরসাইকেল বিআরটিতে গিয়ে মালিকানা পরিবর্তন করে তুলে দেন ডালিয়ার হাতে। ইউটিউবার ইকবালের হাত ধরেই ডালিয়ার ইউটিউবে হাতেখড়ি। তার সঙ্গে অভিনয় করেন ডালিয়া। অটোচালক আনসার সদস্য ডালিয়ার ফাঁদে পড়ে আজ পথে বসেছেন। ডালিয়া তার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ মামলা করেন। সেই মামলায় তিন মাস জেল খাটেন হবিগঞ্জের সুনির্মল।
এরপর থেকেই গ্রাম ছাড়া এই আনসার সদস্য। বলেন, ডালিয়ার প্রতারণায় হেরে গিয়ে জীবন অনেকটা আত্মগোপনে। এরপর প্রবাসী স্বামীকে বিয়ে করে গেছেন বিদেশে। সেখানে গিয়ে হাতিয়েছেন ১৭ ভরি স্বর্ণ, লিখে নিয়েছেন জমি ও নগদ টাকা। উল্টো সেই স্বামীর বিরুদ্ধে দিয়েছেন মানবপাচারের মামলা। সৌদি-আরব প্রবাসী এনামুল তার ১২তম স্বামী। ২০২২ সালের নভেম্বরে বিয়ে করেন ডালিয়াকে। এক মাসের মাথায় নিয়ে যান সৌদি-আরব। সেখানে গিয়ে এনামূলের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন ১৭ ভরি স্বর্ণ, লিখে নেন ১৩ লাখ টাকার জমি। এ ছাড়া আদায় করেন ১২ লাখ টাকা। স্ত্রীর নির্যাতনের বিষয়ে এনামূল বলেন, আমাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে ডালিয়া। এরপর আমার পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলে দেন। এবং ৬০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে আমার বিরুদ্ধে এখন মানবপাচারের মামলা দিয়ে হয়রানি করছেন। তার বিরুদ্ধে এনামূলও নির্যাতন-প্রতারণাসহ একাধিক মামলা করেন। মগবাজারে অবস্থিত একটি কাজী অফিসের কাজী ওয়ালীউল্লাহ বলেন, ডালিয়ার ডিভোর্সের বিষয়টি জানি। তবে কতোগুলো বিয়ে হয়েছে সে সম্পর্কে এই মুহূর্তে জানা নেই।
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |