৬০তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাপুটে জয় ছিনিয়ে নিয়েছেন রিপাবলিকান প্রার্থী এবং ‘জাতীয়তাবাদী’ ডোনাল্ড ট্রাম্প। ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের রানিংমেট এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট এবং পপুলার ভোট দুই ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য ব্যবধানে হারিয়ে আট বছর পর রেকর্ড সৃষ্টি করে জয় পেয়েছেন ৭৯ বছর বয়সী এই রিপাবলিকান প্রার্থী। ১৩১ বছর পর মার্কিন রাজনীতিতে পরাজিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ফের জয়লাভ করেছেন তিনি। ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটকে হটিয়ে ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প নির্বাচিত হবার পর গোটা দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিসহ এ অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ চার দেশ ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়বে তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়ে গেছে।
ভোটগ্রহণের একদিন পর বুধবার (৬ নভেম্বর) ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হবার পর দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি এবং ভূরাজনীতিতে তার সুস্পষ্ট প্রভাব পড়তে পারে বলে এমন শঙ্কা ধারণা করা হচ্ছে ।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে সুস্পষ্ট চীনবিরোধী অবস্থান ও পদক্ষেপের আলোকে বলা যায়, দক্ষিণ এশিয়ায় বিশেষত চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত-চীনের বৈরিতা আরও তীব্রতর হতে পারে। ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন ফেডারেল সরকার বেইজিংয়ের প্রভাব রুখে দিতে নয়াদিল্লি এবং ওয়াশিংটনের মধ্যে কৌশলগত সম্পর্ক আরও জোরদার করতে পারে।
নরেন্দ্র মোদির প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার ওপর গুরুত্বারোপ করতে পারে ট্রাম্প প্রশাসন। এটি অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলতে পারে। এদিকে, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা সরিয়ে নেয়া এবং পাকিস্তানের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি দক্ষিণ এশিয়ায় নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
ট্রাম্পের ইরানবিরোধী কঠোর নীতিমালার ফলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে তেহরান থেকে আমদানিকৃত তেলের দাম লাফিয়ে বাড়তে পারে। এতে কৌশলগত স্থিতিশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তবে এই সম্ভাব্য প্রভাবগুলো স্থানীয় ইস্যু, পরিস্থিতি এবং অন্যান্য আঞ্চলিক পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করবে।
মোদি ও বিজেপির জন্য আশীর্বাদ: ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেনের সম্পর্কের ধরন অনেকটাই ভিন্ন। ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিমদের কাছে অনেকটা কট্টরপন্থী হিসেবে বিবেচিত মোদির সঙ্গে জাতীয়তাবাদী এবং অনেকটা ডানপন্থী ট্রাম্পের ব্যক্তিগত এবং কৌশলগত সম্পর্ক বেশ উষ্ণ। ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদকালে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা অনেক জোরালো হয়।
‘হাউডি মোদি’ এবং ‘নমস্তে ট্রাম্প’ এমন ইভেন্টগুলোতে দুজনের সুসম্পর্ক স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। এদিকে, ডেমোক্রেট এবং মধ্যপন্থী থেকে অনেকটা বামপন্থী হিসেবে পরিচিত বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গেও ভারতের কৌশলগত সম্পর্ক জোরালো ছিল, বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন এবং কোয়াড জোটের পারস্পরিক সহযোগিতার ইস্যুতে।
তবে মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ইস্যুতে প্রশ্ন তুলেছে বাইডেন প্রশাসন। এতে করে তাদের সম্পর্ক কিছু ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠে।
সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে বিপরীতধর্মী দুই ঘরানার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মোদির সম্পর্ক জোরালো হলেও কৌশলগত অগ্রাধিকারে পার্থক্য রয়েছে।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গ: বাংলাদেশের অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে এই নির্বাচনে পরাজিত ডেমোক্রেটিক পার্টির শীর্ষ নেতাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এবার রিপাবলিকান বা জাতীয়তাবাদী ট্রাম্পের সঙ্গে ড. ইউনূস সরকারের সম্পর্ক কেমন হবে তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের সঙ্গে মধ্যপন্থী এবং অনেকটা বামপন্থী ডেমোক্র্যাটদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কারণে জো বাইডেন-কমলা হ্যারিস প্রশাসনের সময়ে তার কূটনৈতিক কার্যক্রম সহজতর হয়েছিল। তবে ট্রাম্পের মতো রিপাবলিকান প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক কিছুটা ভিন্ন রূপ নিতে পারে। রিপাবলিকানদের নীতি সাধারণত জাতীয় স্বার্থকেন্দ্রিক এবং নির্দিষ্ট নীতি ও আর্থিক সহযোগিতার উপর বেশি গুরুত্ব দেয়। ট্রাম্প ফের নির্বাচিত হওয়ায় ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের আন্তর্জাতিক সমর্থনে কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে, বিশেষ করে মানবাধিকার ও আর্থিক বিষয়ে রিপাবলিকানদের সংবেদনশীল ভূমিকা এ ক্ষেত্রে নতুন বাধা হয়ে দেখা দিতে পারে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অ্যান্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেহনাজ মোমেনের মতে, সাধারণত আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট বদল হলেও বৈদেশিক নীতিতে খুব বড় পরিবর্তন আসে না। এর পিছনে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় সংস্থা বা কাঠামোগুলোর একটা শক্তিশালী ভূমিকা থাকে। কিন্তু ট্রাম্পকে আমরা দেখেছি কিছু নির্বাচনী প্রচারণায় রাষ্ট্রীয় সংস্থার রূপ বদলে দেয়ার কথা বলছেন। সেটা হলে একটা বড় পরিবর্তন আসতে পারে।
সম্প্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সংখ্যালঘু নির্যাতন সংক্রান্ত একটি টুইট আলোচনা সৃষ্টি করে বাংলাদেশে। তবে বিশ্লেষকেরা এটিকে ভবিষ্যৎ নীতির চেয়ে নির্বাচনে আমেরিকার হিন্দু ভোটার টানার রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেই দেখেন।
এদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জায়গা থেকে তারা ধারণা করছেন, কিছু লবি গ্রুপ হয়তো বা এটাকে ইনফ্লুয়েন্স করতে চেয়েছে এবং সেই আলোকেই তার এই স্টেটমেন্টটা এসেছে।
এদিকে, বাংলাদেশের তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন কয়েকটি পাঁতানো নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে কঠোর অবস্থানে থাকলেও পরবর্তীতে হাসিনা সরকারের প্রতি ভারতের অকাট্ট সমর্থনই ওয়াশিংটনকে নমনীয় অবস্থানে যেতে বাধ্য করে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, ‘ট্রাম্পের যে টুইট সেখানেও যে ভারতের একটা ভূমিকা আছে সেটা আমরা মোটামুটি আন্দাজ করতে পারি। ট্রাম্প জয়ী হলে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে ভারত ভূমিকা পালন করতে চাইবে। সেক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক না হলে সেখানে ভারতের দিক থেকে এক ধরনের নেতিবাচক উপাদান থাকার একটা শঙ্কা থাকবে। (ট্রাম্পের জয়ের খবরের আগে হুমায়ুন কবিরের বক্তব্য এটি।)
পাকিস্তানে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে: ট্রাম্প ফের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় পাকিস্তানে কয়েকটি সম্ভাব্য প্রভাব দেখা যেতে পারে। ট্রাম্পের ভারত-প্রীতি এবং চীন-বিরোধী মনোভাবের ফলে পাকিস্তানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ও নজরধারী বাড়তে পারে। বিশেষত চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতা এ ক্ষেত্রে ইসলামাবাদের জন্য হিতেবিপরীত হয়ে উঠবে। এর আগে, ট্রাম্প প্রশাসন পাকিস্তানকে সীমিত পরিসরে সামরিক ও আর্থিক সহায়তা দিয়েছিল। এই মেয়াদে তিনি সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে পাকিস্তান ইস্যুতে আরও কঠোর অবস্থানে যেতে পারেন।
এদিকে, আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে পাকিস্তানকে চাপের মুখে রাখা হতে পারে, যা আঞ্চলিক নিরাপত্তায় স্পষ্ঠভাবে প্রভাব ফেলবে। তবে এসব কিছুই তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিভিন্ন চলকের ওপর নির্ভর করবে।
শ্রীলঙ্কায় কী প্রভাব পড়তে পারে: শ্রীলঙ্কায় চীনের বিনিয়োগ এবং বন্দর প্রকল্পের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কিছুটা চাপ বাড়তে পারে কলম্বোর নতুন নির্বাচিত বেইজিংপন্থী সরকারের ওপর। পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার ধারক যুক্তরাষ্ট্র সেখানে চীনের আধিপত্য কমিয়ে আনতে দেশটিতে নিজস্ব প্রভাব বাড়াতে চাইবে।
দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের বিরুদ্ধে কৌশলগত আধিপত্য বজায় রাখতে ট্রাম্প শ্রীলঙ্কার সঙ্গে সামরিক ও কৌশলগত সহযোগিতা বাড়াতে চাপ প্রয়োগ করতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসন সম্ভবত গোটা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শ্রীলঙ্কাকে একটি কৌশলগত অংশীদার হিসেবে দেখতে চাইবে, যা যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের যৌথ কৌশলগত উদ্যোগের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
মানবাধিকার ইস্যুতে চাপ: যদিও রিপাবলিকান প্রশাসন ডেমোক্র্যাটদের তুলনায় বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার ইস্যুতে অপেক্ষাকৃত কম সরব থাকে, তবে আন্তর্জাতিক মঞ্চে দেশটির বিতর্কিত মানবাধিকার পরিস্থিতির দিকে নজরদারি বাড়তে পারে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিশ্বাসী ট্রাম্প প্রশাসন কলম্বোর সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর দিকে জোর দিতে পারে। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে মার্কিন বাণিজ্য চুক্তি এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক সহায়তায় পরিবর্তন আসতে পারে। তবে এই প্রভাবগুলো পরিস্থিতি এবং উভয় দেশের কূটনৈতিক উদ্যোগের ওপর নির্ভর করবে।
সুূুত্রঃ চ্যানেল 24
প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে। |