প্রচ্ছদ জাতীয় ‘খালা, আমি আপনার জামাই হতে চাই’—পুতুলকে দেখেই জিয়ার সরাসরি প্রস্তাব

‘খালা, আমি আপনার জামাই হতে চাই’—পুতুলকে দেখেই জিয়ার সরাসরি প্রস্তাব

‘খালা, আমি আপনার জামাই হতে চাই’—এই সরল অথচ দৃঢ় উচ্চারণের মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছিল শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার দাম্পত্য জীবনের পথচলা। ব্যক্তিগত জীবনের এই অধ্যায়টি ছিল অনেকটাই নীরব, সাধারণ এবং আবেগময়—যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে যায়।

খালেদা জিয়ার ডাকনাম ছিল পুতুল। কলেজে পড়ার সময়েই জিয়াউর রহমান তার নানা মকবুল ও মামা ছবির মুখে পুতুলের সৌন্দর্যের কথা শুনেছিলেন। তারা বলতেন, অন্ধকার রাতে পুতুলকে দেখলে মনে হবে আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। এই বর্ণনা জিয়ার মনে গভীর রেখাপাত করে। দূর সম্পর্কের খালাত বোন পুতুলকে একবার দেখার আগ্রহ তৈরি হয় তার মধ্যে।

অবশেষে সুযোগ আসে। পুতুলকে দেখেই নানা ও মামার কথার সত্যতা উপলব্ধি করেন জিয়া। উজ্জ্বল, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা ও স্বাভাবিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তিনি মনের ভেতর স্বপ্ন বুনতে শুরু করেন তাকে ঘিরে। সে সময় জিয়াউর রহমান ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন। ডিএফআইয়ের অফিসার হিসেবে তার পোস্টিং ছিল দিনাজপুরে। দিনাজপুরে চাকরির সময় মাঝেমধ্যেই তিনি খালেদা জিয়াদের ভাড়া বাসায় যেতেন।

খালেদা জিয়া ম্যাট্রিক পাস করার পর একদিন জিয়া সরাসরি তার মায়ের কাছে গিয়ে বলেন, ‘খালা, আমি আপনার জামাই হতে চাই।’ এমন অকপট প্রস্তাবে প্রথমে হেসে ফেলেন খালেদা জিয়ার মা বেগম তৈয়বা মজুমদার। পরে বিষয়টি পরিবারের অন্য সদস্যদের জানানো হয়।

পরিবারে শুরুতে দ্বিধা ছিল। খালেদা জিয়ার বয়স কম, তখনও পড়াশোনার মধ্যে। বড় দুলাভাই মোজাম্মেল হক সদ্য আমেরিকা থেকে ফিরে আসায় এ বিয়েতে রাজি ছিলেন না। তার যুক্তি ছিল, ডিগ্রি পাস না করা পর্যন্ত বিয়ে কীভাবে হয়। পাশাপাশি জিয়া সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা—এই বাস্তবতাও বিবেচনায় আসে। তবে জিয়ার ব্যক্তিত্ব, আচরণ ও আন্তরিকতায় ধীরে ধীরে পরিবারের আপত্তি কাটে। জিয়াও নিয়মিত খোঁজখবর নিতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত সবাই বিয়েতে সম্মতি দেন।

খালেদা জিয়ার মা তৈয়বা মজুমদারের ভাষ্য অনুযায়ী, জিয়ার নানা মকবুল চাচা আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। ১৯৬০ সালের আগস্ট মাসে ঢাকার মুদিপাড়ার বাসায় খুব সাধারণ আয়োজনে তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। কোনো জাঁকজমক ছিল না, শুধু আকদ হয়। গায়েহলুদ হয়েছিল, পুতুলের হাতে মেহেদি দেওয়া হয়েছিল, পরানো হয়েছিল হলুদ শাড়ি। জিয়ার পক্ষে এসেছিলেন তার নিকটাত্মীয়রা এবং একজন পাঞ্জাবি সহকর্মী অফিসার। এক বছর পর ঢাকার শাহবাগ হোটেলে—বর্তমান পিজি হাসপাতাল—তাদের বিবাহোত্তর সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়।

বিয়ের পর জিয়া অবসর পেলেই খালেদা জিয়াকে নিয়ে আত্মীয়দের বাসায় বেড়াতে যেতেন। বড় বোন খুরশীদ জাহানের খুলনার খালিশপুরের বাসায় তারা কয়েকদিন ছিলেন। খুরশীদ জাহানের স্মৃতিতে, দুজনকে দেখে কখনো নতুন জামাই–বউ মনে হয়নি। জিয়া রান্নাঘরে এসে বড় আপার কাছে খাবার আবদার করতেন—সেমাই ঠান্ডা করে রাখতে বলতেন, মাংস রান্না হলে এক টুকরো চেয়ে বসতেন। এসব ঘটনায় পুতুল লজ্জায় পড়লেও জিয়াকে নিয়ে মজা করতেন।

১৯৬৫ সালে চাকরিসূত্রে জিয়া খালেদা জিয়াকে নিয়ে পাকিস্তানে যান। সে বছর পাক–ভারত যুদ্ধের সময় তারা পাকিস্তানেই ছিলেন। জিয়াউর রহমান ‘খেমকারান’ রণাঙ্গনের ‘বেদীয়ান’-এ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানির কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধে অংশ নেন এবং বীরত্ব প্রদর্শন করেন। যুদ্ধকালীন সময়ে খালেদা জিয়া পাকিস্তানের বান্নো এলাকায় ছিলেন। পরিবার থেকে নিয়মিত খোঁজ নেওয়া হলে তিনি বলতেন, অযথা চিন্তা না করতে—তিনি ঠিক আছেন।

পাকিস্তান থেকে ফেরার পরের স্মৃতিও উঠে এসেছে পরিবারের কথায়। বেগম তৈয়বা মজুমদার জানিয়েছেন, খালেদা জিয়া তার শ্বশুরের কাছ থেকে প্রচুর স্নেহ পেয়েছেন। শ্বশুর তাকে আদর করতেন, নানা জিনিস কিনে দিতেন। শাশুড়ির পাকিস্তান রেডিওতে গান গাওয়ার কথাও তিনি গর্বের সঙ্গে বলতেন।
মায়ের ভাষায়, জিয়া ও পুতুল ছিলেন সত্যিকারের মধুর দম্পতি। জীবনের কোনো পর্যায়েই তারা একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেননি। এক সাধারণ পারিবারিক জীবন থেকেই ধীরে ধীরে খালেদা জিয়া উঠে আসেন দেশের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে—যার শুরুটা হয়েছিল একটি সরল বাক্য দিয়ে, ‘খালা, আমি আপনার জামাই হতে চাই।’

সূত্রঃ ইনকিলা