
জুলাই আন্দোলনের অগ্রসৈনিক ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত ওসমান হাদি–এর জানাজা ও দাফনের সময় একটি বিষয় অনেকের দৃষ্টি কাড়ে- কফিনে লেখা ছিল ‘ওসমান গণি’। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও জনপরিসরে প্রশ্ন ওঠে, পরিচিত নাম ওসমান হাদি হলে কফিনে ভিন্ন নাম কেন?
ওসমান হাদি- এই নামেই যাঁকে দেশের মানুষ চিনেছে, তবে তাঁর প্রকৃত নাম ওসমান গণি। সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় হওয়ার সময় তিনি ‘ওসমান হাদি’ নামেই পরিচিতি লাভ করেন। তবে পারিবারিক ও সরকারি নথিতে তাঁর নাম ছিল ওসমান গণি।
আসল নাম বনাম পরিচিত নাম
পরিবার ও ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, ওসমান গণিই তাঁর প্রকৃত ও আইনগত নাম। জন্মনিবন্ধন, শিক্ষাগত সনদ এবং অন্যান্য সরকারি নথিতে এই নামই ব্যবহৃত হয়েছে। অন্যদিকে, সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি পরিচিতি পান ‘ওসমান হাদি’ নামে- যা মূলত তাঁর আন্দোলনকালীন পরিচয়।
নাম পরিবর্তনের পেছনের কারণ
জানা গেছে, ওসমান গণি তাঁর প্রয়াত পিতা মাওলানা শরিফ আব্দুল হাদি–এর নামানুসারেই ‘হাদি’ নামটি গ্রহণ করেন। আন্দোলনের সময় তিনি নিজেকে ‘শরিফ ওসমান হাদি’ হিসেবে পরিচিত করেন। এর আগে তিনি সাহিত্যচর্চায় ‘সীমান্ত শরিফ’ ছদ্মনামেও পরিচিত ছিলেন।
কফিনে কেন লেখা হলো ‘ওসমান গণি’
পারিবারিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, জানাজা ও দাফনের ক্ষেত্রে আইনগত ও পারিবারিকভাবে স্বীকৃত নাম ব্যবহার করা হয়। সে কারণেই কফিনে লেখা হয় ‘ওসমান গণি’। পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য, এটি ধর্মীয় ও সামাজিক রীতির সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।
বিভ্রান্তি নয়, বাস্তবতা
বিশ্লেষকদের মতে, জনপরিসরে পরিচিত নাম ও নথিভুক্ত নাম ভিন্ন হওয়া নতুন নয়। বহু রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক ব্যক্তিত্বই আন্দোলন বা সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে আলাদা নাম ব্যবহার করে থাকেন। ওসমান গণির ক্ষেত্রেও বিষয়টি তেমনই।
পরিচয় ও রাজনৈতিক ভূমিকা
ওসমান গণি ছিলেন গণআন্দোলনভিত্তিক সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম ইনকিলাব মঞ্চ এর মুখপাত্র। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং রাষ্ট্রীয় জবাবদিহির দাবিতে তিনি ছিলেন সোচ্চার। বিভিন্ন কর্মসূচি, সমাবেশ এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর বক্তব্য তরুণ সমাজের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
সহযোদ্ধাদের ভাষ্যমতে, ওসমান গণি ছিলেন স্পষ্টভাষী ও আপসহীন একজন সংগঠক। অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্ভীক অবস্থান নেওয়াই ছিল তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
আন্দোলন ও জনসম্পৃক্ততা
ইনকিলাব মঞ্চের ব্যানারে তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে সমন্বয় করে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, রাজনৈতিক সহিংসতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার ঘটনায় তিনি নিয়মিত প্রতিবাদ জানাতেন। তাঁর বক্তব্যে তরুণদের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনার প্রতিফলন স্পষ্ট ছিল।
২০২৪ সালের আগস্টে অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষায় বাংলাদেশ পরিচালনার স্বপ্ন নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ইনকিলাব মঞ্চ। পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের লক্ষ্যে তরুণদের প্রস্তুত করতে গড়ে তোলেন ইনকিলাব কালচারাল সেন্টার।
নাম পরিচয়ের গল্প
জানা গেছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর তিনি ‘শরিফ ওসমান হাদি’ নামে পরিচিতি পান। এর আগে তিনি ‘সীমান্ত শরিফ’ ছদ্মনামে কবিতা লিখতেন। প্রয়াত পিতা মাওলানা শরিফ আব্দুল হাদির নামানুসারেই তিনি নিজেকে ‘শরিফ ওসমান হাদি’ হিসেবে পরিচিত করে তোলেন।
পারিবারিক পরিচয়
শিক্ষক পরিবারের সন্তান শরিফ ওসমান হাদির জন্ম ১৯৯৩ সালের ১ জানুয়ারি। তাঁর গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠি জেলার নলছিটি পৌরসভার খাসমহল এলাকায়। তাঁর বাবা প্রয়াত মাওলানা শরিফ আব্দুল হাদি ছিলেন নলছিটি সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার সাবেক উপাধ্যক্ষ ও খাসমহল জামে মসজিদের পেশ ইমাম। মা তাসলিমা হাদি গৃহিণী।
পরিবারের একাধিক সদস্য শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে বড় ভাই (দ্বিতীয় সন্তান) ড. আবু বকর ছিদ্দিক বরিশালের বাঘিয়া আল আমিন কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও গুঠিয়া বাইতুল আমান জামে মসজিদের খতিব। চতুর্থ ভাইবোন মাছুমা নলছিটি ইসলামি সিনিয়র মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক। ভাই ওমর বিন হাদি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে সুগন্ধা ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরিজমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। বড় বোন ফাতেমা বেগম ও তৃতীয় বোন ইয়াসমিন আক্তার গৃহিণী।
স্ত্রী রাবেয়া ইসলাম জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। তাঁদের একটি ৯ মাস বয়সী পুত্রসন্তান রয়েছে।
আহত হওয়া ও মৃত্যু
গত ১২ ডিসেম্বর দুর্বৃত্তদের গুলিতে গুরুতর আহত হন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখ সারির যোদ্ধা ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হলেও ১৮ ডিসেম্বর রাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তাঁর মৃত্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গন, সামাজিক সংগঠন ও আন্দোলনকর্মীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। শনিবার (২০ ডিসেম্বর) দুপুর ২টায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
সমর্থকদের কাছে ওসমান গণি- যিনি পরিচিত ছিলেন ওসমান হাদি নামে- ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন এক সাহসী কণ্ঠ। স্বল্প সময়েই তিনি আন্দোলনভিত্তিক রাজনীতিতে যে দৃঢ় অবস্থান তৈরি করেছিলেন, তা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে আলোচিত হয়ে থাকবে।
সূত্র : বিডি২৪লাইভ













































