
মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান রক্তক্ষয়ী সংঘাত বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ তৈরি করেছে। দিন যত যাচ্ছে, উত্তেজনার মাত্রা ততই বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি এখন চীনের দিকে—বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে তারা এই সংকটে কী ভূমিকা রাখবে, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন।
ইসরায়েলের ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ শুরুর পর সাত দিন পেরিয়ে গেছে। এই অভিযানে মূলত ইরানের পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র, সামরিক ঘাঁটি ও শাসকগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে হামলা চালানো হচ্ছে। এতে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) শীর্ষ কমান্ডারসহ গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক বিজ্ঞানীরা নিহত হয়েছেন।
ওয়াশিংটনভিত্তিক এক মানবাধিকার সংস্থার তথ্যমতে, ইরানে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৬৩৯ জন নিহত হয়েছে, যার মধ্যে ২৬৩ জন বেসামরিক নাগরিক এবং আহতের সংখ্যা ১ হাজার ৩০০ ছাড়িয়েছে।
এই ঘটনার পাল্টা প্রতিশোধ হিসেবে ইরান শত শত ড্রোন ও প্রায় ৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের দিকে নিক্ষেপ করে। এতে ইসরাইলে কমপক্ষে ২৪ জন নিহত এবং শতাধিক মানুষ আহত হয়েছে। সংঘাতটি এখন আঞ্চলিক গণ্ডি পেরিয়ে বৈশ্বিক নিরাপত্তার হুমকিতে রূপ নিচ্ছে।
এমন অবস্থায় চীন কাকে সমর্থন করবে—এই প্রশ্ন উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক পরিসরে।
চীনের রেনমিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র বিশ্লেষক ঝো রং বলেন, চীনের অবস্থান শান্তির পক্ষে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় যেমন নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছিল, এবারও চীন সেই একই অবস্থানেই থাকবে। তিনি জানান, চীন কোনো পক্ষের হয়ে সরাসরি যুদ্ধে জড়াবে না, তবে নৈতিকভাবে ইরানকে সমর্থন করবে এবং ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটি আন্তর্জাতিক ঐক্য গড়ে তোলার পক্ষে কাজ করবে।
চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং গত বৃহস্পতিবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপে ইসরায়েলকে অবিলম্বে শত্রুতামূলক কর্মকাণ্ড বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। চীনা বার্তা সংস্থা সিনহুয়ার প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট শি বলেন—যত দ্রুত সম্ভব এই সংঘাত বন্ধ করা দরকার, যাতে উত্তেজনার ঘূর্ণিপাক ছড়িয়ে না পড়ে এবং যুদ্ধ আরও বিস্তৃত আকার না নেয়।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, তারা ইরান ও ইসরায়েল থেকে তাদের নাগরিকদের সরিয়ে নিতে শুরু করেছে। মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গু জিয়াকুন বলেন, চীন যুদ্ধবিরতির জন্য সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা নিয়েও দুশ্চিন্তা বাড়ছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক বক্তব্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন, ইরানের সঙ্গে আলোচনার সম্ভাবনা থাকলেও তিনি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন কি না, তা পরিষ্কারভাবে বলেননি। তার ভাষায়, “আমি এটা করতেও পারি, নাও করতে পারি। কেউ জানে না আমি কী করব।”
বিশ্লেষক ঝো রং মনে করেন, ট্রাম্প যদি মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোর ওপর হামলার ঝুঁকি না দেখেন, তাহলে সরাসরি যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে জড়ানোর ব্যাপারে এখনই আগ্রহী হবেন না। তিনি বলেন, ট্রাম্প সম্ভবত চাপ বাড়িয়ে ইরানকে আলোচনায় বাধ্য করতে চাইছেন।
চীনের বিশ্লেষকদের মতে, ইরান প্রতিশোধ নিতে চাইছে ঠিকই, কিন্তু অভিজ্ঞ কমান্ডারদের মৃত্যুর পর এখন যারা নেতৃত্বে আছেন, তারা তুলনামূলকভাবে নবীন এবং যুদ্ধকৌশলে দুর্বল। ফলে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বড় পরিসরের জবাব দিতে পারলেও, তা কার্যকরভাবে প্রতিদান হয়ে উঠছে না।
বর্তমান পরিস্থিতিতে চীন সরাসরি যুদ্ধে না জড়ালেও, ইরানকে কূটনৈতিক ও নৈতিক সমর্থন দিয়ে সহায়তা করতে পারে এবং যুদ্ধবিরতি চুক্তির মাধ্যমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।