প্রচ্ছদ জাতীয় হুট করে শেখ হাসিনার পতন-দেশত্যাগ, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কোন পথে

হুট করে শেখ হাসিনার পতন-দেশত্যাগ, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কোন পথে

টানা ১৪ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের পর মাত্র কয়েক দিনের ছাত্র-জনতার উত্তাল আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে বন্ধুপ্রতীম দেশ ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। অনেকটা হুট করে ক্ষমতাচ্যুতির ঘটনায় তার দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে কার্যত চরম বিপর্যয় ও হতাশা নেমে এসেছে। দলটির ‘হতভম্ব’ নেতাকর্মীদের অনেকের মধ্যেই তৈরি হয়েছে তীব্র ক্ষোভ এবং বিস্ময়। তাদের লৌহমানবী নেতৃত্ব এমনভাবে পর্যদস্ত হতে পারে তার কোন ধারণা একদিন আগেও তারা আঁচ করতে পারেননি। গত দু’দিনে দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে এমন ধারণা পেয়েছেন সংবাদকর্মীরা। খবর বিবিসির।

এমন পরিস্থিতিতে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরাই কার্যত এখন ‘আত্মগোপনে’ এবং কবে তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন কিংবা আদৌ পারবেন কি-না তা নিয়েও উদ্বিগ্ন অনেকে। এর ফলে দেশের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী এই দলটিকে টিকিয়ে রাখা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে নেতাকর্মীদের মধ্যে। তবে একমাত্র শেখ হাসিনার জন্মস্থান গোপালগঞ্জে ‘তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করার’ প্রতিবাদে মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) দু’ দফা মিছিল ও সমাবেশ করেছেন আওয়ামী লীগের একদল নেতাকর্মী। বুধবার তার শপথ নিয়েছেন তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার।

আরও পড়ুন : শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর যা ঘটছে ভারতে

এ অবস্থায় শেখ পরিবারের যে তিনজন শেখ হাসিনার স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন তাদের মধ্যে রয়েছেন, সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যার একমাত্র ছেলে জয়। এছাড়া রয়েছেন শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা এবং একমাত্র মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। তবে মঙ্গলবার (৬ আগস্ট) রাতে ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগে দেয়া সাক্ষাৎকারে সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, শেখ পরিবারের কেউ এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব কিংবা রাজনীতিতে আসছেন না। এবং তার মা শেখ হাসিনা রাজনীতিতে আর সংক্রিয় হবেন না।

এদিকে, দলটির মধ্যম পর্যায়ের একজন নেতা বলেন, অন্তবর্তীকালীন সরকারে কারা আসে সেটা দেখে এবং যদি সম্ভাব্য ধরপাকড় এড়ানো সম্ভব হয়, তাহলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হবার পর নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের চেষ্টা করবেন তারা। তবে তারা সবাই তাদের নাম ও পরিচয় প্রকাশ না করার অনুরোধ করেছেন।

এদিকে শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে থাকা তার ছেলে সজিব ওয়াজেদ জয় বিবিসিকে জানিয়েছেন যে তার মা আর রাজনীতিতে ফিরবেন না এবং তিনি হতাশ। এর মাধ্যমে দেশের রাজনীতির মতো ‘আওয়ামী লীগেও আপাতত শেখ হাসিনা অধ্যায় শেষ হলো’ বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন।

‘তবে রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। কিছুদিন আগেও যেমন আজকের পরিস্থিতি অবাস্তব ছিলো। তবে এখনকার পরিস্থিতি বিবেচনা করলে ও তার ছেলের জয়ের কথা আমলে নিলে আপাতত তার রাজনীতিতে ফেরা কঠিন’, বলেন তিনি।

প্রসঙ্গত, সোমবার দুপুরে শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা সামরিক হেলিকপ্টারে প্রথমে ত্রিপুরার আগরতলা ও পরে সেখান থেকে বিশেষ বিমানে দিল্লি পৌঁছান।

এর পরপরই ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢুকে পড়ে আন্দোলনকারীরা এবং ওই দিন বিকেলেই আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয় ধানমণ্ডি ৩২ নাম্বারের বঙ্গবন্ধু ভবন ও জাদুঘর। হামলা হয় শেখ হাসিনার স্বামী মৃত: ওয়াজেদ মিয়ার ধানমন্ডির বাসভবন সুধাসদনেও। এরপর সারাদেশে দলটির বহু সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও নেতাদের বাড়িঘরে হামলা হয়েছে সারাদেশে।

যদিও বিশ্বস্ত একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরীসহ প্রবীণ নেতারা ঢাকাতেই তাদের বিবেচনায় নিরাপদ স্থানে অবস্থান করছেন।

আন্তর্জাতিক এবং ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাতকারে জয় বলেছেন তার মা একদিন আগে অর্থাৎ রোববার থেকেই পদত্যাগের চিন্তা করছিলেন। যদিও দলের সিনিয়র নেতাদের সবাই এ বার্তা পাননি বা তাদেরকে এ বিষয়ে কোন ইঙ্গিত দেয়া হয়নি। কিংবা সিনিয়র নেতাদের একটি বড় অংশ বিষয়টি নিয়ে পুরোপুরি অন্ধকারে ছিলেন। তবে ধারণা করা হচ্ছে যে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ সিনিয়র নেতাদের একটি অংশ পরিস্থিতি অনুধাবন করে সরে পড়তে পেরেছেন।

রোববারই আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর দুজন সদস্য আব্দুর রহমান ও ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছিলেন ছাত্র আন্দোলনকে তারা রাজপথেই মোকাবেলা করবেন। অর্থাৎ আন্দোলন দমন করে ক্ষমতায় থাকার বিষয়ে তখনো তারা ছিলেন আত্মবিশ্বাসী।

সেইদিনও আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর সাথে পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষ হয়েছে এবং এসব সংঘর্ষে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

সোমবার শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার পর থেকে ওই দুই নেতাই আত্মগোপনে রয়েছেন এবং পরে তাদের সাথে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে তাদের একজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন এমন একজন মঙ্গলবার বিবিসি বাংলাকে বলেছেন “ওনারা ঘুণাক্ষরেও ভাবেন নি যে এমন কিছু হয়ে যাবে”।

তবে ধারণা করা হয় শেখ হাসিনার সরকার ও দলের কিছু লোকজন অবস্থা অনুধাবন করে শনি ও রবিবার ঢাকা ছেড়ে দেশের বাইরে চলে গেছেন।

‘এ অবস্থা কিন্তু নতুন নয়’
আওয়ামী লীগের খুলনা অঞ্চলের একটি জেলার প্রবীণ একজন নেতা অবশ্য বলেছেন তিনি মনে করেন তার দল এমন অবস্থায় এবারেই প্রথম পড়েনি।

‘পঁচাত্তরের পনেরই অগাস্টে আমি ডিগ্রির ছাত্র ও দলের কর্মী । হুট করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর পেলাম। তখন আমরা এমন পরিস্থিতিতেই পড়েছিলাম। বহু বছর পালিয়ে ছিলাম। ঘুরে দাঁড়াতে সময় লেগেছিলো। এখন শেখ হাসিনার পর কে হাল ধরবেন আমি জানি না। তবে সময় হলে কেউ না কেউ আসবেই,’ বলছিলেন তিনি।

প্রসঙ্গত, পচাত্তরের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যার পর ১৯৮১ সালের মে মাসে দেশে ফিরে এসে দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন শেখ হাসিনা। তার আগে অবশ্য ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দলটির রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন শুরু হয়েছিলো।

যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আছেন এমন একজন বলছেন যে এবারের নতুন পরিস্থিতি মেনে নেয়া ও এতে ধাতস্থ হতে দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের অনেক সময় লাগবে। ‘অনেকেই হয়তো রাজনীতিই ছেড়ে দিবেন। পরে কি হবে আমি জানি না,’ মঙ্গলবার বিবিসি বাংলার সাথে আলাপকালে বলছিলেন তিনি।

এবারের সহিংসতায় ঢাকার কাছে মানিকগঞ্জের আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রতিপক্ষের হামলায় আহত হয়ে পরে মারা গেছেন। ওই এলাকাতেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন এমন একজন বলছিলেন যে তিনি মনে করেন ‘শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ায় আওয়ামী লীগের ঘুরে দাঁড়ানোর আপাতত কোন সুযোগ নেই’।

‘দেশত্যাগ মেনে নেয়া কঠিন’
আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক লীগের একজন নেতা বিবিসি বাংলাকে বলেছেন তিনি মনে করেন ক্ষমতা হারানোর চেয়ে বড় আঘাত হলো দলীয় সভানেত্রীর দেশ ছাড়া।

“আমি জানি না এটা কেন তিনি করলেন। যদিও বোঝাই যাচ্ছে পরিবারের চাপেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। কিন্তু এর মূল্য অনেক হবে আমাদের জন্য,” কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একজন সাবেক নেতা তার ফেসবুকে লিখেছেন, “এর থেকে মৃত্যু হয়তো শ্রেয় ছিল…!! বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে…আপনাকেও না হয় মেরে ফেলতো…আমি গৌরবের মৃত্যু নিয়েই যেতে চাই….আমি গৌরবের পরাজয় চাই….!!” অর্থাৎ শেখ হাসিনার এভাবে চলে যাওয়াটাও দলের অনেকে মেনে নিতে পারছেন না। তারা মনে করছেন এটি তাদের জন্য অসম্মানজনক, যা রাজনৈতিক ভাবেও তাদের জন্য বড় একটি আঘাত।

আবার কেউ কেউ ফেসবুক পোস্ট দিয়ে বলছেন যে পরিস্থিতি যাই হোক না কেন দলের আদর্শ নিয়েই থাকবেন তারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক ছাত্রলীগ নেতা হেমায়েত উদ্দিন অবশ্য লিখেছেন, “আমি মুজিব আদর্শের সৈনিক, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই আদর্শ বুকে ধারণ করেই চলবো….”।

প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও জনপ্রিয় সাইট থেকে হুবহু কপি করা। তাই দায়ভার মুল পাবলিশারের। এরপরও কোন অভিযোগ বা ভিন্নমত থাকলে আমাদেরকে জানান আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব সমাধান করে নিতে।