নির্বাচনের আগে বাজার নিয়ে চিন্তায় সরকার

আমদানির পথে হাঁটলে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে- এমন ধারণা থেকে কয়েকটি পণ্য আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। কিন্তু আমদানিতেও কমছে না ওইসব পণ্যের দাম। বাজারে গড়ে ওঠা অসাধু সিন্ডিকেটের কব্জা থেকে মুক্ত হচ্ছে না বাজার। তাদের কারসাজিতে মিলিয়ে যাচ্ছে আমদানির সুফল।

দরজায় কড়া নাড়ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ১ নভেম্বর শুরু হবে নির্বাচনের ক্ষণ গননা। ঠিক এমন সময় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সরকারের অন্য সফলতা ম্লান করে দিচ্ছে। বিষয়টি ক্ষমতাসীনদেরও নজরে এসেছে। এখন প্রাণপণ চেষ্টা চলছে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের, মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। অসহায় হয়ে পড়েছেন খোদ বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।

অকারণে প্রতিনিয়ত দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে সরকারের কোনো সমীকরণই কাজে আসছে না। ডিম, আলু, পেঁয়াজের দাম বেঁধে দিলেও সেই দামে ক্রেতারা কিনতে পারছেন না এসব পণ্য।

এমন পরিস্থিতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণে আরও পাঁচ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। নতুন করে আরও পাঁচ প্রতিষ্ঠানকে পাঁচ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাজারে ডিমের সরবরাহ বৃদ্ধি ও বাজারদর স্থিতিশীল রাখতে আমদানি নীতি আদেশ-২০২১-২৪-এর শর্ত পরিপালন সাপেক্ষে গতকাল নতুন করে এই পাঁচ প্রতিষ্ঠানকে ডিম আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এর আগে দুই দফায় ১০টি প্রতিষ্ঠানকে ১ কোটি করে মোট ১০ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে প্রথম দফায় চারটি প্রতিষ্ঠানকে চার কোটি এবং দ্বিতীয় দফায় ছয়টি প্রতিষ্ঠানকে ছয় কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। গতকাল নতুন করে আরও পাঁচ প্রতিষ্ঠানকে পাঁচ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়ার কথঅ জানায় মাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ১৫ প্রতিষ্ঠানকে ১৫ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

নতুন করে আমদানির অনুমতি পাওয়া প্রতিষ্ঠান পাঁচটি হলো- ইউনিয়ন ভেঞ্চার লিমিটেড, জে এফ জে প্যারাডাইস কানেকশন, লায়েক এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স লাকি এন্টারপ্রাইজ ও মেসার্স পিংকি ট্রেডার্স। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে গতকাল এ তথ্য জানানো হয়।

এদিকে, এ পর্যন্ত ১৫টি প্রতিষ্ঠানকে মোট ১৫ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হলেও এখনো কোনো ডিম আমদানি হয়নি। আমদানির ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পরও আমদানি ও রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে আমদানির অনুমতিপত্র বা আইপি নিতে হয়। ওই আইপির বিপরীতে আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খোলে ব্যাংকগুলো। এত দিন আইপি জটিলতায় অনুমোদনপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো আমদানির ঋণপত্র খুলতে পারছিল না। গত সপ্তাহের শেষে ১০ প্রতিষ্ঠানকে আইপি দিয়েছে আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়। তাই প্রতিষ্ঠানগুলো আমদানির ঋণপত্র খুলতে শুরু করেছে। আমদানির অনুমোদন পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে, চলতি সপ্তাহেই ভারত থেকে ডিম আমদানি হবে। তবে মোড়কজাত করে তা বাজারে ছাড়তে কয়েক দিন সময় লাগতে পারে বলে জানান আমদানিকারকেরা।

প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় ডিম আমদানির অনুমোদন পাওয়া একাধিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভারত থেকে আমদানি করা ডিম দেশে এলে প্রতিটি ডিম বাজারে ১০ টাকায় বিক্রি হতে পারে।

এখন বাজারে প্রতিটি ডিম বিক্রি হচ্ছে ১২ থেকে সাড়ে ১২ টাকায়। যদিও গত ১৪ সেপ্টেম্বর সরকার প্রতিটি ডিমের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য বেঁধে দিয়েছে ১২ টাকা। ডিমের পাশাপাশি আলু ও পেঁয়াজের দামও বেঁধে দেওয়া হয়। সরকারের বেঁধে দেওয়া এ দাম কার্যকরে মাঠে নামে ভোক্তা অধিদপ্তরসহ স্থানীয় প্রশাসন। দেশের বিভিন্ন স্থানে চালানো হয় অভিযান, জরিমানাও করা হয়। তারপরও তিন পণ্যের বেঁধে দেওয়া দাম কার্যকর হয়নি বাজারে।

এমন পরিস্থিতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণে নতুন করে আরও ডিম আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর আগে প্রথম দফায় ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয় গত ১৮ সেপ্টেম্বর। ওই দিন চার প্রতিষ্ঠানকে চার কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে মীম এন্টারপ্রাইজ, প্রাইম এনার্জি ইমপোর্টার্স অ্যান্ড সাপ্লায়ার্স, টাইগার ট্রেডিং ও অর্ণব ট্রেডিং লিমিটেড। আর দ্বিতীয় দফায় ছয় প্রতিষ্ঠানকে ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয় গত ২১ সেপ্টেম্বর। ওই দিন আমদানির অনুমতি পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে চিজ গ্যালারি, পপুলার ট্রেড সিন্ডিকেট, এমএস রিপা এন্টারপ্রাইজ, এসএম করপোরেশন, বিডিএস করপোরেশন ও মেসার্স জয়নুর ট্রেডার্স। সাধারণত দেশে ডিম আমদানি নিষিদ্ধ। তবে বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সম্মতিতে আমদানির অনুমতি দিতে পারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বর্তমান বাজার পরিস্থিতি তাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চার শর্তে এখন পর্যন্ত ১৫ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে।

এদিকে গতকাল দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক। পেঁয়াজ ও আলুর দাম বেঁধে দিলেও সরকার তা বাস্তবায়ন করতে পারছে না বলে জানিয়েছেন তিনি।

সাংবাদিকদের উদ্দেশে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না, আলুর দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। এ নিয়ে সমালোচনা করেন, আমরা মেনে নেব। কারণ, এটা আমাদের দুর্বল দিক। কিন্তু আমাদের সবল দিকগুলোও দয়া করে মিডিয়াতে তুলে ধরবেন।’

কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘সব বিবেচনায় এ বছর চাল উৎপাদন, বিতরণ এবং মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় আমরা একটা ভালো অবস্থায় রয়েছি। আমি সাংবাদিক বন্ধুদের বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করছি, এ ব্যাপারগুলোও যেন গণমাধ্যমে তুলে ধরা হয়।’

গতকাল সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভাকক্ষে খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির সভা শেষে আলু ও পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সরকার হাল ছেড়ে দিয়েছে কি না- এমম প্রশ্ন রাখেন সাংবাদিকেরা। জবাবে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘মোটেই হাল ছেড়ে দিইনি। আমরা এখনো যথেষ্ট তৎপর রয়েছি। উৎপাদনের পার্টটা হলো আমাদের কৃষি মন্ত্রণালয়ের। বাজার মনিটর করার দায়িত্ব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। তারপরও আমি দায়িত্ব এড়াতে পারি না। কেবিনেট সিস্টেমে সব মন্ত্রী এটার জয়েন্ট রেনপনসিবিলিটি, সব সময়ই এটা।’

তিনি বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি। কোল্ড স্টোরেজের মালিকরা খুবই অসহযোগিতা করছে। তারা ঠিকমত সরবরাহ করছে না, এটা বড় অন্তরায়। নানাভাবে আমাদের কর্মকর্তারা মাঠ লেভেলে তাদের চাপ সৃষ্টি করলে সাপ্লাই-ই দেয় না, বন্ধ করে চলে যায়। এ ধরনের কিছু ব্যাপার রয়েছে। তা সত্ত্বেও প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।’

জুলাই থেকে এ পর্যন্ত এই মরা কার্তিকেও চাল আমদানি করতে হয়নি জানিয়ে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘এদিক দিয়ে আমরা খুব একটা ভালো অবস্থায় আছি। গত বোরো মৌসুমে চাল সংগ্রহের যে টার্গেট নির্ধারণ করেছিলাম সেটি অর্জিত হয়েও দুই লাখ টন বেশি সংগ্রহ করতে পেরেছি। এ মুহূর্তে বাজারে চালের দামে নিম্নমুখী ট্রেন্ড রয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে বাজারে চালের দাম কম, সরকারি দাম বেশি, যেজন্য মিলাররা আমাদের চাল দেওয়ার জন্য খুবই আগ্রহী। এখনো তারা চাল দিতে চাচ্ছে।’

আব্দুর রাজ্জাক আরও বলেন, ‘একজন মানুষের জীবনধারণের জন্য যে খাদ্য প্রয়োজন তার ৬৫-৭০ ভাগই খরচ হয় চাল কিনতে। অর্থাৎ ৭০ ভাগই খরচ হয় চাল কেনার জন্য। কাজেই চালটা কিন্তু খাদ্যের প্রথম ও প্রধান উপাদান। পেঁয়াজের দাম আলুর দাম কতটুকু সেটা আমি ওইভাবে বলতে চাই না। তবে চাল নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। মানুষের যে খাদ্য নিরাপত্তা, ন্যূনতম যে খাবারটা সেটা কিন্তু কিনতে পারছে।’

কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘পেঁয়াজ আমাদের দেশে পর্যাপ্ত উৎপাদন হয়, কিন্তু পেঁয়াজ খুবই পচনশীল পণ্য। এপ্রিল-মে মাসে পেঁয়াজ তোলা হয়, তারপর দুই মাসের বেশি থাকে না। পেঁয়াজ পচে যায়, শুকিয়ে যায়। এজন্য পেঁয়াজ নিয়ে আমাদের সমস্যা। নভেম্বর-ডিসেম্বরে বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। গত বছর যথেষ্ট পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছিল, চাষিরা বিক্রি করতে পারেনি। আলুরও একই অবস্থা, রাস্তায় ফেলে দিয়েছে। এবার পরিস্থিতি উল্টো। উৎপাদন কম হওয়ার সুযোগে কোল্ড স্টোরেজ মালিক ও আড়ৎদাররা ব্যাপকভাবে মুনাফা করছে। এতো লাভ করা উচিত নয়। ২০ টাকা খরচ হয় না, বিক্রি করছে ৪০-৫০ টাকায়।’

পেঁয়াজ সংরক্ষণে নতুন প্রযুক্তি আনা হয়েছে জানিয়ে ড. রাজ্জাক বলেন, ‘ওভাবে পেঁয়াজ রাখলে ৫ শতাংশও পচে না। এ প্রযুক্তি যদি আমরা নিয়ে যেতে পারি আগামী দুই বছরের মধ্যে বিদেশ থেকে কোনো পেঁয়াজ আমদানি করতে হবে না। নতুন জাত বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন, হেক্টরপ্রতি ৪০-৫০ টন উৎপাদন হয়। আগামী দিনে বাংলাদেশে পেঁয়াজেরও কোনো সমস্যা থাকবে না।’

কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘পেঁয়াজ কেন আমদানি করতে দিইনি, আমরা চেয়েছি গত বছর কৃষকরা দাম পায়নি, এ বছর তারা দাম পাক, এটা আমাদের নীতি ছিল। আপনারা সমালোচনা করেন আমি সেটা মাথা পেতে নিচ্ছি। আমাদের লক্ষ্য হলো পেঁয়াজে স্বনির্ভরতা অর্জন। সেজন্য সাময়িক একটু কষ্ট হয়েছে, মানুষ বেশি দামে কিনেছে, কিন্তু চাষিদের আমরা উৎসাহিত করছি, স্থানীয়ভাবে আমরা পেঁয়াজ উৎপাদন করব। আমাদের ওপর প্রচণ্ড চাপ ছিল ভারত থেকে আমরা কেন আমদানি করছি না। কিন্তু আমরা তাদের কথা শুনিনি। আমরা চেয়েছি যে বাজারে দাম যা আছে থাক আমাদের কৃষকরা উপকৃত হোক, যেন সামনের বছরও তারা পেঁয়াজ চাষ করে।’

তিনি আরও বলেন, ‘শীতকাল আসছে, পর্যাপ্ত সবজি হবে। সব সবজির দামই কমে আসবে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেশি। আরও অন্যান্য খরচ বেড়ে গেছে। দেশে মুদ্রাস্ফীতি আছে। এসব বিবেচনায় এ মুহূর্তে সবজি ও অনেক খাদ্যপণ্যের দাম বেশি।’

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের সভাপতিত্বে সভায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেনসহ কমিটির অন্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।