
বর্তমান সরকারকে চেপে ধরেছে বিদেশি শক্তি। এবারের নির্বাচন যেন ওয়াকওভার পাওয়া নির্বাচন না হয়, তা নিশ্চিত করার দিকে নজর দিয়েছে আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়েরা। মার্কিন দেশ এরই মধ্যে নানাভাবে বোঝাতে চাইছে, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হলে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেবে তারা। মার্কিনরা ইতিমধ্যেই এমন কিছু নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, যা বাংলাদেশ সরকারের জন্য সত্যিই মাথাব্যথার কারণ হতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে কথা বলেছে এবং তাতে বাংলাদেশ যে পোশাক রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে আসছিল, তা উঠে যেতে পারে বলে শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। অধ্যাপক ইউনূসকে নিয়েও আন্তর্জাতিক রাজনীতি শুরু হয়েছে।
সামগ্রিকভাবে এসব ঘটনার বিশ্লেষণ করলে নির্দ্বিধায় যে কথাটি বলা যায় তা হলো, এ দেশে এখন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিকল্প নেই।
যে কেউ বলবেন, জনগণের যদি ভোটের অধিকার না থাকে, তাঁরা যদি নিজের ভোটটি দিতে না পারেন, তাহলে গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্তই তো পূরণ হয় না। অতএব লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা এখন সরকারের দায়িত্ব। ২. এ কথা বলার সময় আমরা মনে রাখি না, দেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হওয়াটাই এই সংকট উত্তরণের একমাত্র পথ নয়। নির্বাচন হতে হবে অংশগ্রহণমূলক, সে তো মোদ্দাকথা। কিন্তু তারপর কী? দেশটাকে গণতান্ত্রিক দেশ বলা হবে, অথচ গণতন্ত্রকে তার মতো বেড়ে উঠতে দেওয়া হবে না, এটা তো মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু এ বিষয়ে কথা বলতে হলে পরিষ্কারভাবে আরও কিছু ব্যাপারে দৃকপাত করা জরুরি। গণতন্ত্রের অন্যতম বড় সংকট হলো, রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর গণতান্ত্রিক চর্চা নেই। রাজনৈতিক দলগুলো চলে দলীয় প্রধানের একক সিদ্ধান্তে। এখানে ভিন্নমত গ্রহণ করা হয় না। শুধু রাজনৈতিক দলের কথা বলছি কেন, আমাদের দেশের যেকোনো প্রতিষ্ঠানই শাসন করে একনায়কতন্ত্র। যে প্রতিষ্ঠান চলে একনায়কতান্ত্রিকভাবে, সেই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারও দেশের শাসনপদ্ধতির সমালোচনা করার সময় ওই ‘একনায়কতন্ত্র’কেই গালাগাল করেন। আমাদের মধ্যে এই দ্বিচারিতা প্রবল। নির্বাচন না হয় হলো অবাধ ও সুষ্ঠু, কিন্তু তারপর কী হবে?
৩. যে দলই সরকার গঠন করুক না কেন, রাষ্ট্রের মূল কাঠামোকে শক্তিশালী করার জন্য আইন, শাসন আর বিচার বিভাগের যে স্বাধীনতা থাকার কথা, সেটা আমরা কতটা নিশ্চিত করতে পেরেছি? নিম্ন আদালতের স্বাধীনতা আছে কি নেই, সেটা তো বহু পুরোনো বিতর্ক। এ কথা অনেকেই বলে থাকেন, নিম্ন আদালত স্বাধীন নয়। কেন এ রকম একটি ধারণার সৃষ্টি হয়েছে, সেটা কি আমরা ভেবে দেখেছি?
প্রশাসন কি আদৌ নিরপেক্ষ আচরণ করে অভ্যস্ত? কেউ ভাববেন না, শুধু আওয়ামী লীগ শাসনামলের কথা বলা হচ্ছে। যে দল যখন ক্ষমতায় এসেছে, সেই দল তখন নিজের পক্ষে পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করেছে। ভবিষ্যৎ তা থেকে মুক্ত থাকবে, এমন কোনো নির্ভরযোগ্য অঙ্গীকার কারও কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।
পুলিশের আচরণ নিয়ে একটি কবিতায় ভারতের কবি শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, ‘পুলিশ কখনো কোনো অন্যায় করে না, তারা যতক্ষণ আমার পুলিশ।’ অবলীলায় একটি সূক্ষ্ম সত্যের প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন কবি। শঙ্খ ঘোষ প্রকাশ্যে কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থক ছিলেন কি না, জানি না, সম্ভবত ছিলেন না। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে এই সত্য উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন। আমাদের আমলাতন্ত্র ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়। যে দল যখন ক্ষমতায়, সেই দলের তল্পিবাহক হতে তাদের কোনো দেরি হয় না। আমলাতন্ত্র হয়ে গেছে রাজনৈতিক। অথচ সত্যিকার কোনো গণতান্ত্রিক দেশে আমলাতন্ত্রের কোনো রং থাকে না। এক সরকার যে পরিকল্পনা করে গেছে, তা বাস্তবায়ন করে যাবে ক্ষমতায় আসা নতুন দল। বাতিল করবে না এবং আমলাতন্ত্র সেই ধারাবাহিকতায় কাজগুলো এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমাদের আমলা ও পুলিশ আদতে কোন আচরণ করে থাকে? সেটাকে কি গণতান্ত্রিক দেশের আমলাতন্ত্র বা পুলিশের আচরণ বলা যায়? ব্রিটিশ আমলের রাজকীয় জীবনযাপনের যে অভ্যাস আয়ত্ত করেছে আমাদের আমলাতন্ত্র, তাকে গরিব দেশের মাপে পুনর্জন্ম দেওয়া কি সম্ভব? নাকি তারা এই রাজকীয় আয়েশেই কাটিয়ে যাবে দিন-কাল, জনগণ যেখানে তাদের সেবক হয়ে রইবে। অথচ তাদেরই হওয়ার কথা ছিল জনগণের সেবক। এই প্যারাডক্সটা কাটলই না আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে। ৪. আমরা গণতন্ত্র দেখেছি, স্বৈরতন্ত্র দেখেছি। আমরা দেখেছি, স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে আঁতাত করা রাজনীতিবিদদের। আমরা দেখেছি গণতান্ত্রিক পথে ক্ষমতায় আসার পর গণতন্ত্রকে খর্ব করা রাজনীতিবিদদের। আমরা দেখেছি মুক্তিযুদ্ধের নাম করে ফায়দা লোটা গোষ্ঠীকে। মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারের প্রতি বিশ্বস্ত না থেকে আখের গুছিয়ে নেওয়া মানুষদের কি কম দেখেছি আমরা? আমরা দেখেছি, পাকিস্তানি ধ্যানধারণায় মগ্ন স্বাধীনতাবিরোধীদের রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে, আমরা দেখেছি ওয়াজের ময়দান থেকে অশ্লীল শব্দাবলি সহযোগে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী ধর্ম ব্যবসায়ীদের। আমজনতা শুধু দেখেই গেল। তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে কেউ বলল না, ‘আমরা আপনার সেবা করার জন্য এসেছি। আপনার জন্যই আমাদের রাজনীতি;’ বরং ভোট দিতে পারলে এক দিনের রাজা এই আমজনতার পাশে সত্যিই দাঁড়ানোর মতো নেতাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। করপোরেট যুগ নয়া উপনিবেশ হয়ে ঘাড়ে চড়ে বসার পর আমরা মানুষে-মানুষে দূরত্বটা আরও বাড়িয়ে নিয়েছি। ৫. ধরা যাক, নির্বাচন হবে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। আন্তর্জাতিক মহল খুশি হবে। আমরাও খুশি হব। তারপর কী হবে? বুঝলাম, সেই নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা আমাদের গণতান্ত্রিক ভাষা খুঁজে পাব। কিন্তু কোন সে ভাষা? কোন সে গণতন্ত্র? এখন পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো দলের কাছ থেকে তো শুনতে পেলাম না, সরকার পরিবর্তন হলে কোন কাজগুলো তারা করবে, যাতে গণতন্ত্র রক্ষা পায়? যদি গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা কোনো দলের না থাকে, তাহলে সেই দলগুলো কি আদৌ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে? আদৌ তাদের মাধ্যমে গণতন্ত্র রক্ষা পাবে? দুর্নীতির যে আকাশছোঁয়া খবরগুলো ভেসে বেড়ায় ইথারে, তার দায়ভার কার? কোন সরকারের আমলে এই দুর্নীতি চলেনি? চাটার দল যেমন চেটে খেয়েছে, সামরিক শাসকেরাও সেই সুযোগ ছাড়েননি, গণতন্ত্রের রক্ষকেরাও ভক্ষক হতে সময় নেয়নি। তাহলে আমাদের দেশে যা চলছে দীর্ঘকাল ধরে, সত্যিই কি তাকে ‘গণতন্ত্র’ বলে মেনে নিতে হবে? প্রশ্নটা নতুন নয়। গণতন্ত্র পোক্ত হয় গণতান্ত্রিক আচরণ দিয়ে। ধীরে ধীরে প্রতিদিনের অনুশীলনে তা দৃঢ় ভিত্তি পায়। আর তা না হয়ে ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’ করা হলে যদি ট্যাঁকে টাকা ঢোকে, তাহলে কে আর ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবে? এর চেয়ে বরং সরকারের ভালো এবং মন্দ সব কর্মকাণ্ডের জয়গান গেয়েই জীবন পার করে দেওয়া হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
৬. সরকারি দল আর বিরোধী দলের সমর্থকেরা এখনো যে কাজটি করে চলেছেন, তা হচ্ছে পরস্পরের দিকে কাদা ছোড়াছুড়ি। দুই দলই প্রমাণ করতে চাইছে, প্রতিদ্বন্দ্বী দলের চেয়ে খারাপ কিছু হয় না! দুই পক্ষই অন্য পক্ষের কাপড় টেনে খুলছে; অর্থাৎ অন্যকে নগ্ন করাই যেন তাদের উদ্দেশ্য। নিজের শরীরে কাপড় থাকল কি না, সে হিসাবও তারা করছে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দিকে তাকালেও বোঝা যায়, অন্যকে ছোট করতে পারলে কতটা দন্ত বিকশিত হয়ে ওঠে একেক জনের। শুধু দেশেই নয়, দেশের বাইরেও এই ঝগড়া তুমুলভাবে চলতেই থাকে। রাজনীতিকে কলুষিত করে কতটা রুচিহীনতার জন্ম দেওয়া যায়, তা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে যে কেউ লুফে নিতে পারবে। ৭. আমরা ভুলেই গেছি, পাকিস্তান নামের একটি উদ্ভট দেশের বিরুদ্ধে লড়াই করে একদা একটা দেশ স্বাধীন করেছিলাম। ভুলেই গেছি, সেই দেশটি কেমন হবে, তার একটি রূপরেখাও আমাদের ছিল। ভুলে গেছি, ব্রিটিশ শোষকদের পর পাকিস্তানি শোষকদের তাড়িয়েছিলাম শুধু এই কারণে যে, আমাদের দেশটা আমরাই চালাব এবং এ দেশে কোনো শোষণ থাকবে না। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি কখনোই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল না। জন্মের পর থেকেই তা ছিল আমলাতন্ত্র ও সেনাতন্ত্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। পুরো পঞ্চাশ-ষাট ও সত্তর দশকের বাঙালি জাগরণ ছিল এই আমলা-সেনা শাসন-শোষণের প্রতিক্রিয়া। কিন্তু স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর আমরা কি আদৌ মুক্ত হতে পারলাম?
শুধু ভোট বা নির্বাচন নিয়ে বড় বড় কথা নয়, গণতন্ত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবগুলো বিষয়কেই একটা জায়গায় এনে নিশ্চিত করতে হবে গণতান্ত্রিক গতিধারা, নইলে ‘যেই লাউ সেই কদু’ মার্কা জীবন থেকে আমাদের উদ্ধার মিলবে না।
জাহীদ রেজা নূর, উপসম্পাদক আজকের পত্রিকা