ড. ইউনূস ও খালেদা জিয়াকে নিয়ে ফ্রি প্রেস জার্নালের নিবন্ধ

জাতীয়: ‘বিগ ব্রাদার’ শব্দটির অর্থ বেশ নেতিবাচক এবং আপত্তিকর। কোনো বড় ও শক্তিশালী দেশ যখন একটি ছোট ও দুর্বল দেশের ওপর অযাচিত চাপ প্রয়োগ করে, তখন সেটিকে আধুনিক কূটনীতির ভাষায় ‘বিগ ব্রাদার’ বলে ডাকা হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় নিজের প্রভাব বিস্তারের জন্য ভারতকেও প্রায়ই ‘বিগ ব্রাদার’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

কিন্তু এখন নয়াদিল্লির উচিত এই ‘বিগ ব্রাদার’ না হয়ে সত্যিকারের বড় ভাই হিসেবে বাংলাদেশের সরকারকে সঠিক পরামর্শ দেওয়া, যাতে দেশটির সরকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে হেনস্থা বন্ধ করে। সরকার যদি ভারতের কথা শোনে, তাহলে তা ভারতের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল করবে।

খালেদা জিয়া দুবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির প্রধান। ২০২০ সাল থেকে তিনি হাউস অ্যারেস্টে আছেন। গত সপ্তাহে লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য খালেদা জিয়ার জার্মানি যাওয়ার অনুমতি প্রত্যাখ্যান করেছে সরকার। তার লিভার সিরোসিস, ডায়াবেটিস এবং হার্টের সমস্যা রয়েছে। বাংলাদেশের চিকিৎসকরা প্রকাশ্যে বলছেন, খালেদা জিয়া বিদেশে জরুরি চিকিৎসা না পেলে তার মৃত্যুর ‘উচ্চ ঝুঁকি’ রয়েছে। বাংলাদেশের ১৭ জন শীর্ষ চিকিৎসকের একটি প্যানেল ঘোষণা করেছে, তাদের আর কিছু করার নেই।

সরকার শুধু খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বাইরে যেতেই বাধা দিচ্ছেন না, বরঞ্চ যুক্তি দিচ্ছেন- তার বয়স এত বেশি যে এমনিতেই যে কোনো সময় তার মৃত্যু হতে পারে।

বর্তমানে বেঁচে থাকা বাংলাদেশিদের মধ্যে সব থেকে বিখ্যাতদের একজন প্রফেসর ইউনূস। ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার জেতার পর তিনি বাংলাদেশিদের কাছে নায়কে পরিণত হয়েছিলেন। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে তার যুগান্তকারী কাজ বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশে দারিদ্র্যবিমোচনে ভূমিকা রাখছে। গরিবের ব্যাংকার হিসাবে পরিচিত প্রফেসর ইউনূস বিশেষ করে নারীদের চরম দারিদ্র্য থেকে বের করে এনেছেন। বাংলাদেশের বাইরেও বহু মানুষ তাকে অনুসরণ করেন। অনেক বিশ্বনেতাকেই তার ব্যক্তিগত বন্ধুদের মধ্যে গণনা করা যেতে পারে।

কিন্তু এই মাসে ঢাকায় দুর্নীতি দমন কমিশনে হাজির হতে হয়েছে প্রফেসর ইউনূসকে। এ জন্য তাকে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরের সফর সংক্ষিপ্ত করতে হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদের পর ট্রাইব্যুনাল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ইউনূস নির্ভয়ে ঘোষণা করেন, তিনি কাউকে ভয় পান না- কারণ তিনি কোনো অপরাধ করেননি। ইউনূসের বদনাম ও তাকে ছোট করতে বছরের পর বছর ধরে নানা কথা বলছে সরকার। সরকার প্রকাশ্যে নোবেল বিজয়ীকে ‘গরিবের রক্তচোষা’ বলে অপমান করেছে। যে মামলাটিতে দুর্নীতি দমন কমিশনে তাকে উপস্থিত হতে হয়েছিল, তা তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া ১৭৫টি ফৌজদারি ও শ্রম মামলার একটি। সবগুলো মামলাই করা হয়েছে ২০০৯ পরবর্তী সময়ে।

প্রফেসর ইউনূস ২০০৭ সালে একটি রাজনৈতিক দল চালুর চেষ্টা করেছিলেন আর মূলত তার খেসারত এখনও তাকে দিতে হচ্ছে। সে সময় শেখ হাসিনা এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়া উভয়কেই সেনা-সমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন কারাগারে পাঠিয়েছিল। বাংলাদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যক্তিদের একজন হিসেবে সাধারণ বাংলাদেশিরা ইউনূসকে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের আহ্বান জানিয়েছিল। সে ডাকেই সাড়া দিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শাসনব্যবস্থার একটি বিকল্প তৈরি করতে চেয়েছিলেন তিনি।

প্রফেসর ইউনূস আনুষ্ঠানিকভাবে ‘নাগরিক শক্তি’ নামে একটি দল চালু করেছিলেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, আমি আর রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারছি না। কিছু করার জন্য এখনই সেরা সময়। পরিস্থিতি অনুধাবন করে দুই মাসের মধ্যেই তিনি তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ত্যাগ করেছিলেন। তার খেসারত এখনও তাকে দিতে হচ্ছে।

ইউনূসের বিরুদ্ধে চলমান বিচারিক হয়রানি বন্ধের জন্য ১৭০ জনেরও বেশি বিশ্ব নেতা ইতোমধ্যে শেখ হাসিনাকে খোলা চিঠি দিয়েছেন। স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও বিল ক্লিনটন, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন এবং শতাধিক নোবেল বিজয়ী। কিন্তু সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। ইউনূসকে ফাঁসানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছে সরকার। পাশাপাশি তাকে পাঠানো চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের ইউনূসের পক্ষে লবিং বন্ধ করতে বলা হয়েছে। এটিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ সরকার।

এস এন এম আবদি : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক