পেটের পীড়ায় আক্রান্ত সাভারের মো. সুরুজ মিয়া (৫১)। এলাকার চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চিকিৎসা নিয়েও সুস্থ হননি তিনি। অবশেষে গত রোববার এসেছেন রাজধানীর শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। রোগ শনাক্তে চিকিৎসক তাকে এন্ডোস্কপি, আল্ট্রাসনোগ্রামসহ কয়েকটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরামর্শ দেন। এসব পরীক্ষার জন্য সুরুজ মিয়াকে হাসপাতালের বাইরে যেতে হয়নি। কারণ, এই হাসপাতালেই আছে স্বল্পমূল্যে সব রকম পরীক্ষার ব্যবস্থা।
সুরুজ মিয়ার পুত্র ইয়াকুব কালবেলাকে বলেন, ‘বাবাকে এর আগে সাভারে যাকে দেখিয়েছিলাম, তিনিও গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে নিয়ে আসতে বলেছিলেন। এখানে এসে দেখি রোগীর ভিড় কম। প্রাইভেট হাসপাতালের মতো ডাক্তার সময় নিয়ে বাবাকে দেখেছেন। টেস্ট যা দিয়েছেন, সব এখানেই করাতে পেরেছি। এখানে যেসব পরীক্ষা হয়, সেটা দেশের অন্য কোথাও হয় না। চিকিৎসা ও পরীক্ষার ব্যবস্থা নিয়ে আমি খুশি। এখন বাবা সুস্থ হয়ে উঠলেই হয়।’শুধু মো. সুরুজ মিয়া বা তার ছেলে নন, একই রকম অভিজ্ঞতা জানালেন লিয়াকত আলী, অমল সেন আর ব্যারিস্টার হুমায়ূন কবির পল্লবও। শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় তারা সবাই সন্তুষ্ট।
সম্প্রতি এখানে চিকিৎসা নিয়েছেন উচ্চ আদালতের আইনজীবী হুমায়ূন কবির পল্লব। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের রোগী ব্যবস্থাপনা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও শৃঙ্খলা দেখে ব্যক্তিগতভাবে আমার ভালো লেগেছে। সত্যি কথা বলতে, শুরুতে আমি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসতে চাইনি। কিন্তু এখানে এসে চিকিৎসা গ্রহণের পর সেবার মান ও ব্যবস্থাপনা দেখে আমার ধারণা বদলে গেছে। আমার ধারণা ছিল, অন্য পাঁচটি সরকারি হাসপাতালের মতো গ্যাস্ট্রোলিভারেও নাই নাইয়ের রাজ্য হবে। সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা বেসরকারি ল্যাবে করাতে হবে। চিকিৎসা পেতে ভোগান্তি থাকবে। কিন্তু শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট হাসপাতালে এসব সংকট নেই। এখানে আমি এন্ডোস্কপি ও ব্লাড টেস্ট করিয়েছি। সেই রিপোর্ট একটি নামি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসককেও দেখিয়েছিলাম। তিনিও বলেছেন, গ্যাস্ট্রোলিভারের রিপোর্ট বিশ্বমানের।’
পরিপাকতন্ত্র, প্যানক্রিয়াজনিত গ্যাস্ট্রো ইন্টোলজি, লিভারসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অবস্থান রাজধানীর মহাখালীতে। জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের পাশে ২ একর জমিতে ১০তলা ভবনে চলছে এর কার্যক্রম। ২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবর ২৫০ শয্যার এই হাসপাতালটি উদ্বোধন করা হয়। তারপর থেকে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিন শত শত রোগী এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন। এ ছাড়া বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণের পর অনেকে নিয়মিত ফলোআপ করান এই হাসপাতালে। এমনকি বিদেশি কূটনীতিকরাও হাসপাতালে নিয়মিত চিকিৎসা নিয়ে থাকেন।
সরেজমিন শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের প্রতিটি বিভাগ ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১০ টাকার টিকিটে প্রতিদিন গড়ে প্রায় সাড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ রোগী বর্হিবিভাগে সেবা গ্রহণ করেন। হাসপাতালে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য বরাদ্দ ৮০ কোটি টাকায় বিশ্বমানের যন্ত্রপাতি ক্রয় করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এসব যন্ত্রপাতির মাধ্যমে গুণগত চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। লিভার-সংক্রান্ত ছাড়াও রেডিওলোজি, ইমেজিং ও প্যাথলজি ল্যাবগুলোতে অন্যান্য রোগ নির্ণ️য়ের সেবা প্রদান করা হয় হাসপাতালটিতে। কভিড প্রাদুর্ভ️াবের সময় ঢাকার সিএমএইচের পর চিকিৎসাসেবায় গুণমানের বিবেচনায় শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউটের নাম উঠে আসে। কভিডকালে নিয়মিত চিকিৎসার পাশাপাশি কভিড আক্রান্তদেরও চিকিৎসা দেওয়া হয়। তখন গুরুত্ব বিবেচনায় বিদেশি কূটনীতিকদের চিকিৎসার জন্যও হাসপাতালটিকে নির্ধারিত করা হয়। এ ছাড়া প্রবাসীদের করোনার টিকা প্রদানের ব্যবস্থাও করা হয় এই হাসপাতালে। বিভিন্ন সময় হাসপাতাল পরিদর্শন করে আমেরিকা, ইউরোপ ও সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন টিম চিকিৎসাসেবা মানের প্রশংসা করে।
চিকিৎসকরা জানান, রোগ নির্ণ️য়ের মূল উপাদান হচ্ছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি। যন্ত্রপাতি মানসম্মত না হলে সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় সম্ভব নয়। আর রোগ নির্ণ️য় সম্ভব না হলে চিকিৎসকের দেওয়া ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন) কোনো কাজে আসে না। সেজন্য রোগ নির্ণ️য়ে মানসম্মত যন্ত্রপাতি হলো মূল উপাদান। শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ইউরোপ, আমেরিকা ও সিঙ্গাপুরের সমমানের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। আস্থার সঙ্গে এখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন হাইকোর্টে️র বিচারপতি, বিদেশি কূটনীতিক, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, ডিজিসহ অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের কর্ম️কর্ত️া থেকে শুরু করে হতদরিদ্রসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ।
জনস্বাস্থ্যবিদদের দাবি, এই হাসপাতালের মতো দেশের প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে যেন রোগ নির্ণয়ের মানসম্পন্ন পরীক্ষা ও চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। তাহলে রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় কমে আসবে। সেই সঙ্গে চিকিৎসার নামে বিদেশে গমনের হারও কমে আসবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পেটের পীড়ায় আক্রান্ত রোগীদের রোগ নির্ণয়ে বিভিন্ন অত্যাধুনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়। শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে এসব পরীক্ষার সুযোগ রয়েছে। এর বাইরে অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ নেই। পাকস্থলি এবং কোলন ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করার জন্য যে মানের এন্ডোস্কপি ও কোলনস্কপি দরকার, এই হাসপাতালে নামমাত্র মূল্যে সেই পরীক্ষা করার সুযোগ রযেছে। এখানে বিনা অপারেশনে মাইক্রোওয়েভ অ্যাভুলেশনের মাধ্যমে ক্যান্সার থাইরয়েড ও লিভারের জটিল সমস্যার চিকিৎসা করা হচ্ছে। রয়েছে অত্যাধুনিক পিকচার আর্কাইভ সিস্টেম (প্যাক্স)।
এই প্যাক্স মেশিন সম্পর্কে️ জানতে চাইলে হাসপাতালের রেডিওলজি ইমেজিং বিভাগের চিকিৎসকরা জানান, সিটি স্ক্যান, এমআরআই, এক্স-রে, আল্ট্রাসাউন্ডসহ অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার ইমেজ থ্রিডি আকারে সেন্ট্রাল সার্ভ️ার রুমে (প্যাক্স রুমে) চলে আসে। সেখানে চিকিৎসরা একই রুমে বসে ইমেজ মাধ্যমে থ্রিডি আকারে দেখতে পারেন। প্যাক্স সিস্টেমের মাধ্যমে জুম বা স্ক্রলিং করে যে কোনো রোগের ইমেজ ডেনসিটি, মেজারমেন্ট থ্রিডি আকারে রোগ নির্ণ️য়ে সূক্ষ্মভাবে আইডেন্টিফিকেশন করা হয়। এটি বিশ্বের নির্ভ️ুলভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সর্ব️াধুনিক প্রযুক্তিগত পদ্ধতি। এর মাধ্যমে ডিজিটাল অ্যাক্সেস রোগীর স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা উন্নত করতে পারে। ফলে স্বাস্থ্যসেবা সুবিধাভোগী রোগীরা সময় এবং অর্থ সাশ্রয় করতে পারেন। তা ছাড়া উন্নতমানের চিকিৎসা পেয়ে জটিল রোগীও সুস্থ হয়ে উঠছেন। সম্প্রতি ক্যাপসুল এন্ডোস্কপি চালু করা হয়েছে, যা অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এক পরীক্ষা। একজন মানুষের ক্ষুদ্রান্ত দেখার জন্য আগে যে জটিল টেস্ট করা লাগত, অপারেশন করা লাগত; সেটি না করে শুধু রোগীকে একটি ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়। ক্যাপসুলের ক্যামেরা ছবি তুলে পাঠায়, যা কম্পিউটারে দেখা যায়। এই মেশিনটিসহ এ হাসপাতালে রোগীর সেবায় ব্যবহৃত সব ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছে বেঙ্গল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড সার্জি️ক্যাল কোম্পানি।
শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে সরবরাহকৃত যন্ত্রপাতি সম্পর্কে️ বেঙ্গল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড সার্জি️ক্যাল কোম্পানির স্বত্বাধিকারী জাহের উদ্দিন সরকার কালবেলাকে বলেন, ‘অনেক প্রতিষ্ঠানই আছে, যেখানে শত শত কোটি টাকার যন্ত্রপাতি দেওয়ার পরও রোগীরা সেবা পাচ্ছেন না। যন্ত্রপাতি অকেজো হয়ে পড়ে আছে। আমাদের প্রতিষ্ঠান গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে মাত্র কোটি টাকার যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছে। এসব যন্ত্রপাতির মাধ্যমে রোগীরা মানসম্মত চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন। ওয়ারেন্টি মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও সব ধরনেরর সহায়তা বিনামূল্যে করে যাচ্ছি।’
শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. গোলাম কিবরিয়া কালবেলাকে বলেন, ‘এই প্রতিষ্ঠানে অত্যাধুনিক রেডিওলজি ইমেজিং, আপার এন্ডোস্কপি, কোলনস্কপি, লোয়ার কোলনস্কপি, ইআরসিপি, এন্ট্রাস্কপি, এন্ডোস্নোগ্রাফি, সিটি স্ক্যান, এমআরআই মেশিন, এক্স-রে, ইসিজি এবং অত্যাধুনিক মানের ল্যাবে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। হাসপাতালে যে ইমেজিং সিস্টেম আছে, তা উপমহাদেশের মধ্যে অন্যতম। খাদ্যনালির পরীক্ষার জন্য রয়েছে হাই রেজুলেশনের ম্যানোমেট্রি মেশিন, যা দেশের আর কোথাও নেই। পেস মনিটরিং মেশিনও আমাদের এখানে ছাড়া আর কোথাও নেই। এন্ডোস্কপি মেশিনটি সবচেয়ে ভালো অলেম্পাস ব্র্যান্ডের। আধুনিক ইমেজিং করার জন্য প্রাইভেট হাসপাতাল থেকেও এখানে রেফার করা হয়। এখানকার ল্যাবগুলোও অত্যাধুনিক। হিস্টোপ্যাথলজি ল্যাব, বায়োক্যামিস্ট্রি ল্যাব, মাইক্রোবায়োলজি ল্যাব, ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি ডিপার্ট️মেন্টকে বিশ্বমানের রিপোর্ট️ প্রদান করা হচ্ছে।’
পরিচালক আরও বলেন, ‘হাসপাতালে সব যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছে বেঙ্গল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড সার্জি️ক্যাল কোম্পানি। এসব যন্ত্রপাতির ওয়ারেন্টির সময়কাল ২০২০ সালে শেষ হয়। কিন্তু এখনো কোনো ধরনের চার্জ️ ছাড়া বিনা মূল্যে আফটার সেল সার্ভি️স দিচ্ছে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটি, যা নজিরবিহীন।’