আগামী নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলে মহাবিপদে পড়বে বাংলাদেশ

সারাদেশ: সম্প্রতি বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্কে বড়সড় ফাটল দেখা দিয়েছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যারা বাধাগ্রস্ত করবে তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে বলে ২০২৩ সালের মে মাসে ঘোষণা দিয়েছে। এরই মধ্যে অনেকের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে বলে খবর প্রকাশ হয়েছে। এই ভিসা নিষেধাজ্ঞাই শেষ কথা নয়, আরও বহু ধরনের নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কারণ প্রকাশ্যে না বললেও মার্কিন সরকার নিশ্চিত হয়েছে যে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত সংসদীয় নির্বাচনে তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকার নির্বাচন ব্যবস্থাকে লাইনচ্যুত করে ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্র কোনোমতেই আগামী ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে এমন কার্যক্রম মেনে নেবে না, এই বার্তাই দিয়ে চলেছে তারা।

নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসবে ততই কঠোর হতে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্র ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সরকারের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে তারা আবারও ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন আয়োজনের দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। সে জন্য আশঙ্কা হচ্ছে যে দেশ অদূর ভবিষ্যতে বড় বিপদে পড়তে যাচ্ছে।

শুধু নির্বাচন নয়, অনেক ইস্যুতেই যুক্তরাষ্ট্রকে বহুদিন থেকেই খেপিয়ে চলেছে বাংলাদেশের সরকার। ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেন ২০২০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি ক্ষমতা গ্রহণের পর বিভিন্ন আলামত থেকে বোঝা যাচ্ছিল বাংলাদেশের সরকার সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দৃষ্টিভঙ্গি খুব বন্ধুসুলভ নয়। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময় থেকেই প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে সরকারের বৈরী আচরণ তখনকার মার্কিন প্রশাসনের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। তদানীন্তন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ব্যাপারটি সহজে ভুলে যাওয়ার কথা নয়! ২০২১ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর বাংলাদেশের সরকারের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করে আসছিলেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এতদ্সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে যোগদানের আমন্ত্রণ জানানো হয়। এর আগে বাংলাদেশকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আমলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন চীনবিরোধী সামরিক জোট ‘কোয়াডে’ যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, যে আমন্ত্রণ বাংলাদেশ প্রত্যাখ্যান করেছিল। কোয়াড ছিল যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার প্রস্তাবিত সামরিক জোট। ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে যোগদানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করায় যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি বাংলাদেশবিরোধী অবস্থানে চলে গেছে। এই মার্কিন প্রস্তাবে বাংলাদেশ সাড়া না দেওয়ায় ভারতও নাখোশ হয়েছে কিছুটা। ভারতও মনে করছে, বাংলাদেশ ক্রমে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এরপর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)-এর সাতজন সাবেক ও বর্তমান শীর্ষ কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করে, যা বিশ্বে বাংলাদেশের ভার্বমূতিকে ক্ষুণ্ন করেছে। ২০০৯ সালের পর বাংলাদেশে প্রায় ৬০০টি বিচারবহির্ভূত খুন ও গুমের গুরুতর অভিযোগে মার্কিন সরকার এই নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেছিল।

এর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কর্তৃক আয়োজিত ২০২১ সালের ৯-১০ ডিসেম্বরের গণতন্ত্র সম্মেলনে বিশ্বের ১১০টি দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও বাংলাদেশকে ডাকা হয়নি। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অসন্তোষ স্পষ্ট হয়েছিল। দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশ ভারত, পাকিস্তান, মালদ্বীপ এবং নেপাল ওই গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়েছিল। ভোটের রাজনীতি চালু থাকা সত্ত্বেও বাদপড়া দক্ষিণ এশীয় দেশ ছিল বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কা। এর মানে এই দুদেশের সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলো বিশ্বস্বীকৃতি পায়নি। ভুটান রাজতন্ত্র হিসেবে দাওয়াত পায়নি, আর আফগানিস্তানের মৌলবাদী তালেবান সরকার এখনো মার্কিন স্বীকৃতি না পাওয়ায় ওই সরকারেরও দাওয়াত না পাওয়াই স্বাভাবিক।

বাংলাদেশের ২০১৮ সালের নির্বাচন যে প্রশ্নবিদ্ধ এই সত্যটা গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রণ না পাওয়ায় আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছিল। প্রকৃত প্রস্তাবে মার্কিনিরা বুঝতে পেরেছে, ২০১৮ সালের সংসদীয় নির্বাচনের পথ ধরে গত পৌনে পাঁচ বছর বাংলাদেশের পুরো নির্বাচনী গণতন্ত্রের প্রক্রিয়াই লাইনচ্যুত হয়েছে। এরপর মানবাধিকার-লঙ্ঘন ইস্যুতে র‌্যাবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ বিশ্বকে জানান দিল যে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও সুশাসনের ঘাটতি অগ্রহণযোগ্য পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।

মার্কিন চাপ প্রয়োগের শিকার আরও একবার হয়েছিল বাংলাদেশ, যার ফলে ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধু সরকারকে। বাংলাদেশ কিউবার কাছে পাটের বস্তা রপ্তানি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-আরোপিত অবরোধ কেন লঙ্ঘন করল তার কৈফিয়ত চেয়ে ১৯৭৪ সালে খাদ্যশস্যবাহী কয়েকটি জাহাজকে সাগরের যাত্রাপথ থেকে বিভিন্ন দেশের বন্দরে নোঙর করতে বাধ্য করে যাত্রা বিলম্বিত করে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ফলে, কূটনৈতিক চ্যানেলে দুঃখ প্রকাশ করে কয়েক মাস পর মার্কিন খাদ্যসাহায্য পুনরায় চালু করা গেলেও দুর্ভিক্ষ ঠেকানো যায়নি। প্রফেসর নুরুল ইসলামের বই ‘মেকিং অব এ নেশন বাংলাদেশ : এন ইকনমিস্ট’স টেইল’ এ এই কাহিনির বর্ণনা রয়েছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করায় এখন দেশকে অত বড় বিপদে পড়তে হবে না হয়তো। এতদ্সত্ত্বেও মার্কিন অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আমাদের জন্য বিপজ্জনক হবে।

সরাসরি বলা প্রয়োজন, লাইনচ্যুত ভোটের রাজনীতি অবিলম্বে মেরামত করা সম্পর্কে যদি বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন মহল যত্মবান না হয় তাহলে অদূর ভবিষ্যতে জাতি মহাবিপদে পড়বে বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপের মাধ্যমে। এমনকি এই ইস্যুতে খোদ জাতিসংঘও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করবে না। শাস্তি হিসেবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনী থেকে বাংলাদেশকে বাদ দিলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তখন শুধু যুক্তরাষ্ট্রকে দোষারোপ করে পার পাওয়া যাবে না। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং ব্যালট জবরদখলের মাধ্যমে নির্বাচন ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভে জমা রাখা বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ জব্দ করার মতো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে কিংবা বাংলাদেশ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর অবরোধ আরোপ করে তাহলে আমাদের বিপদের সীমা থাকবে না। সর্বোপরি, জাতিসংঘ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী থেকে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে অপসারণের পদক্ষেপ নিলে নিশ্চিতভাবে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমাদের উদীয়মান অর্থনীতিও এমন পদক্ষেপের ফলে মুখ থুবড়ে পড়বে।

ড. মইনুল ইসলাম : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়